যেসব কারণে রোজা ভাঙ্গে না - জেনে রাখুন
কিছু কিছু কাজ আছে যা রোযার ক্ষতি করে না। কিন্তু অনেকেই এগুলোকে রোজা ভঙ্গের কারণ মনে করেন।
ফলে এরূপ আমল করলে সে রোজা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে পান করে। আবার কেউ কেউ এসব কাজ এড়িয়ে অহেতুক যন্ত্রণা ভোগ করে। সেজন্য রোজাদারদের এসব সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।
যে কারণে রোজা ভাঙ্গে না
01. গলায় ধুলো, ধোঁয়া বা মশা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রবেশ করা।
02. কানে অনিচ্ছাকৃত পানি প্রবেশ করা।
03. স্বল্প পরিমাণে অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত বমি (কামড় দিয়ে নয়)।
04. বমি করার পর একা ফিরে আসুন।
05. চোখের ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করুন।
06. ইনজেকশন নিন
07. ভুল করে খাওয়া-দাওয়া করা।
08. পারফিউম পরুন বা অন্য কিছুর গন্ধ পান।
09. লালা, কফ ইত্যাদি দিয়ে গার্গল করুন। মুখ থেকে
10. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করুন।
11. ঠান্ডার জন্য গোসল করুন।
12. খারাপভাবে হাঁটা তবে মিসওয়াকের কারণে দাঁতে রক্ত পড়ে। তবে শর্ত হলো গলার ভিতর না পৌঁছানো।
13. ঘুমানোর সময় যদি আপনি স্বপ্ন দেখেন।
14. একজন মহিলার দিকে তাকালে অনায়াসে বীর্যপাত।
15. স্ত্রীকে চুম্বন করা, যদি বীর্যপাত না হয় (রোযা না ভাঙলেও রোযার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
ষোল দাঁতের মাঝে আটকে থাকা গোশত খাওয়া (পরিমাণ কম হলে), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
এবার আসুন কুরআন-হাদিসের আলোকে সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করি। মনে রাখতে হবে রোজা ভঙ্গের তিনটি শর্ত রয়েছে:
#রোজা ভাঙার কারণ জেনে নিন
রোজা ভঙ্গকারী ব্যক্তি অজান্তে কারো কাছে আত্মসমর্পণ করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেন:
হে আমাদের প্রভু! আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করলে আপনি আমাদের ধরবেন না। - সূরা বাকারাঃ ২৮৬
তখন আল্লাহ বললেন: 'অবশ্যই আমি তা গ্রহণ করেছি।' অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ "আর যা কিছু ভুলে যাও তাতে কোন পাপ নেই।" অবশ্যই, আপনার হৃদয় যা করছে তার জন্য আপনি দায়ী থাকবেন। আর আল্লাহ সবচেয়ে ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়। '-সূরা আহযাব : ৫
অজ্ঞতার কারণে রোজা না ভাঙ্গার বিষয়টি খুবই বিস্তৃত, এমনও হতে পারে যে আপনি শরীয়ত বিধি সম্পর্কে অবগত নন। যেমন, তিনি মনে করেন এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে না, তাই তিনি তা করেন। বা আইনের সময় বা অবস্থা তার কাছে অজানা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি মনে করেন যে ফজর বা সুবহা সাদিক এখনও উদিত হয়নি, তাই তিনি খাওয়া-দাওয়া চালিয়ে যাচ্ছেন যদিও ফজর উঠে গেছে। অথবা এটা ভেবে দেখুন যে সূর্য অস্ত গেছে, কিন্তু সূর্য এখনও অস্ত যায় নি। এসব কারণে রোজা বিঘ্নিত হবে না। কারণ সহীহ বুখারীতে হযরত আসমা বিনতে আবী বকর (রা.) এর হাদীসে আছে। তিনি বলেনঃ আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় মেঘলা দিনে রোজা ভঙ্গ করেছিলাম এবং তারপর সূর্য উদিত হয়েছিল। '
এখানে তিনি উল্লেখ করেননি যে, নবী (সা.) তাদের রোজা ভাঙার নির্দেশ দিয়েছেন; কারণ তার সময় অজানা ছিল।
#রোজার কথা স্মরণ থাকা
যদি রোজাদার ভুলে যায় এবং রোজাদার কিছু করে ফেলে তাহলে তার রোজা শুদ্ধ হয়ে যাবে এবং তার কাযা আদায় করতে হবে না। যেমনটি সূরা বাকারার আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: 'যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করতে ভুলে যায়, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে, কারণ আল্লাহ তাকে খাবার ও পানীয় দিয়েছেন।'
রাসুল (সাঃ) এর রোজা পূর্ণ করার নির্দেশ রোজা বৈধ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আর ভুলে যাওয়া ব্যক্তির খাদ্য ও পানীয়কে আল্লাহর কাছে উল্লেখ করা প্রমাণ করে যে, এর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ বা দায়িত্ব নেই। কিন্তু যখনই তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় বা কেউ তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়: সে বিরত থাকবে এবং তার মুখে কিছু রাখবে; কারণ এখন ওজন কমে গেছে।
# স্বতঃস্ফূর্তভাবে রোজা ভঙ্গ করা
রোজা ভঙ্গকারী ব্যক্তি যদি নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু করে তবেই তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। অন্যথায় রোজাদারকে জোর করে ইফতার করা হলে তার রোজা শুদ্ধ হয়ে যাবে এবং তার কাযা আদায় করতে হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির কাছ থেকে কুফরের নির্দেশ কেড়ে নিয়েছেন যে ব্যক্তি কুফর করতে বাধ্য হয় অথচ তার অন্তর ঈমানে অটল থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: 'যে ব্যক্তি ঈমানের পর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং তার অন্তরকে কুফরির জন্য উন্মুক্ত রাখে, তার ওপর আল্লাহর গজব পতিত হবে এবং তার জন্য রয়েছে মহা শাস্তি; কিন্তু তার জন্য নয় যে কুফরী করতে বাধ্য হয়েছে বরং যার অন্তর ঈমানে দৃঢ়। - সূরা আন নাহল: 106
অতএব, আল্লাহ তায়ালা যদি জবরদস্তি ও জবরদস্তির কারণে কুফরের আদেশ অপসারণ করে থাকেন, তাহলে কুফরের চেয়ে কম অপরাধ দূর হবে। একইভাবে রাসূল সা. তিনি বললেন: "নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল-ত্রুটি, ভুলে যাওয়া এবং বাধ্যতামূলক ক্ষমা করেছেন।" '
মাসয়ালা : যদি কোনো লোক তার স্ত্রীকে সহবাস করতে বাধ্য করে অথচ সে রোজা পালনকারিনী, তাহলে মহিলার রোজা শুদ্ধ হবে। তাকে সেটার কোনো কাজা করতে হবে না। যদিও লোকটির জন্য বৈধ নয় স্ত্রীকে রোজা অবস্থায় সহবাসে বাধ্য করা। হ্যাঁ, যদি কোনো মহিলা তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল রোজা পালন করে সেটা ভিন্ন কথা। ৎ
মাসয়ালা : চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। হজরত আনাস (রা.) রোজা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন। -আবু দাউদ ১/৩২৩
মাসয়ালা : রাত্রে স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোজার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত।
মাসয়লা : বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকটে ছিলাম। ইতোমধ্যে একজন যুবক এল এবং প্রশ্ন করল, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোজা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি? নবী (সা.) বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ এল এবং একই প্রশ্ন করল। নবী (সা.) বললেন, হাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী (সা.) বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০
মাসয়ালা : অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (এমনকি মুখ ভরে হলেও) রোজা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙ্গবে না। বলা হয়েছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তার রোজা কাজা করতে হবে না। -জামে তিরমিজি: ১/১৫৩, হাদিস : ৭২০
মাসয়ালা : শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙ্গবে না। হজরত কাতাদা (রা.) বলেন, ‘রোজাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোজার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৪/৩১৩
মাসয়ালা : শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোজা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোজার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ। কামভাবের সঙ্গে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোজা ভাঙ্গবে না। তবে রোজা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। আর অপাত্রে কু-দৃষ্টি তো কবিরা গুনাহ। যা রোজা অবস্থায় আরো ভয়াবহ। এতে রোজাদার রোজার ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। হজরত জাবের ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সঙ্গে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে তার রোজা কি ভেঙ্গে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোজা পূর্ণ করবে। ’ –সহিহ বোখারি : ১/২৫৮
মাসয়ালা : মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙ্গবে না। ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটের ভেতর ঢুকে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। ’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/৩৪৯
মাসয়ালা : স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙ্গে না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৬৪
মাসয়ালা : চোখের দু’এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোজার ক্ষতি হয় না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রোজা অবস্থায় সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতর না যায় তাহলে রোজা ভাঙ্গে না। ’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/২০২
মাসয়ালা : সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায় তাহলে রোজা নষ্ট হবে না। হজরত নাফে (রহ.) বলেন, হজরত ইবনে ওমর (রা.) নফল রোজা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এ কারণে রোজা ভেঙ্গে ফেলতেন না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৩৫
মাসয়ালা : চোখে সুরমা ও ড্রপ ব্যবহার করলে। -রদ্দুল মুহতার : ৭/৩৭৯৫; ফাতহুল কাদির : ৪/৩২৭; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/২৬
মাসয়ালা : কোনো ধরনের ইঞ্জেকশন-ইনসুলিন বা টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হয় না, এমনকি গ্লুকোজ ইঞ্জেকশানের দ্বারাও রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। -ফাতাওয়া উসমানি : ২/১৮৬
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url