ষাট গম্বুজ মসজিদ - বাগেরহাট
ষাট গম্বুজ মসজিদ - বাগেরহাট |
ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটির মধ্যে অবস্থিত; বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এই সম্মান প্রদান করে।[১]
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। ষাট গম্বুজ মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১ টি, সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় ৪ টি মোট ৮১ টি। কালের বিবর্তনে লোকমুখে ৬০ গম্বুজ বলতে বলতে ষাট গম্বুজ নামকরণ হয়ে যায়, সেই থেকে ষাট গম্বুজ নামে পরিচিত।
ইতিহাস
সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়।[২] এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। তুঘলকি ও জৌনপুরী নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।
বহির্ভাগ
মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা, ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আজান দেবার ব্যবস্থা ছিল। এদের একটির নাম রওশন কোঠা, অপরটির নাম আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬ সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়,বরং গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো। মিনারে গম্বুজের সংখ্যা ৪ টি-এ হিসেবে গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৮১ তে । তবুও এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের সাত গম্বুজ এবং তা থেকে ষাটগম্বুজ নাম হয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০ টি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।
অভ্যন্তরভাগ
মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্যমন্ডিত। এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে যেখানে ১টি মিহরাব থাকার কথা সেখানে আছে ১টি ছোট দরজা। কারো কারো মতে, খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে নামাজের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, আর এই দরজাটি ছিল দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হত।ইমাম সাহেবের বসার জায়গা হিসেবে রয়েছে মিম্বার।
চিত্রশালা
ষাট গম্বুজ মসজিদ - ভ্রমন
ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। মসজিদটির কোন শিলালিপি না থাকায় ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। তবে মসজিদের স্থাপত্যশৈলী দেখে খান-ই-জাহান ১৫০০ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এ মসজিদে ব্যবহৃত পাথরগুলো রাজমহল থেকে আনা হয়েছিলো। ষাট গম্বুজ মসজিদটি বাংলাদেশের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইউনেস্কো ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।
বিবরণ
মসজিদটি বাইরের দিক দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১০৪ ফুট লম্বা। আর ভিতরের দিক দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৪৩ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৮৮ ফুট লম্বা। মসজিদের দেয়ালগুলো প্রায় ৮ দশমিক ৫ ফুট পুরু। মসজিদটির পূর্ব দিকের দেয়ালে রয়েছে ১১ টি বিরাট খিলানযুক্ত দরজা। অন্য দরজাগুলো থেকে মাঝখানের দরজাটি সবচেয়ে বড়। আর উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালে দরজা আছে ৭টি করে ১৪ টি। মসজিদের চারকোণে চারটি গোলাকার মিনার আছে। প্রতিটি মিনারের চূঁড়ায় রয়েছে একটি করে গোলাকার গম্বুজ। ছাদের কার্নিশের চেয়ে মিনারগুলোর উচ্চতা একটু বেশি। মসজিদের সামনের দিকের দুটি মিনারের একটির নাম রওশন কোঠা এবং অন্যটির নাম আন্ধার কোঠা। মিনারের ভেতরে রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি, আগে এই মিনার থেকে আযান দেবার ব্যবস্থা ছিলো। মসজিদের অভ্যন্তরে মোট ষাটটি স্তম্ভ বা পিলার আছে। স্তম্ভগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ৬ সারিতে মোট ১০টি করে বিন্যস্ত আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথরের তৈরী তবে ৫ টি স্তম্ভ ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। স্তম্ভগুলোর চারপাশের ছাদের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। ষাট গম্বুজ মসজিদে ১১ টি সারিতে সর্বমোট ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। আর মিনারের উপর চারটি গম্বুজ সহ মোট গম্বুজের সংখ্যা ৮১ টি। মসজিদের মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে সাতটি গম্বুজ ছাড়া বাকি ৭৪ টি গম্বুজই অর্ধগোলাকার। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে মিহরাব আছে ১০ টি। মাঝখানের মিহরাবটি বড় ও কারুকার্যপূর্ণ। দক্ষিণ দিকে ৫ টি এবং উত্তর দিকে ৪টি মিহরাব রয়েছে। উত্তর পাশে ১ টি মিহরাবের স্থলে ১ টি ছোট দরজা আছে। অনেকের মতে, খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন আর এই দরজা ছিল তার প্রবেশ পথ। ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রায় ৫০০ মিটার পেছনে রয়েছে বিবি বেগনির মসজিদ। হাতে সময় থাকলে ফুলের কারুকার্যময় মসজিদটি দেখে আসতে পারেন। বিবি বেগনির মসজিদের ৫০০ মিটার পেছনের দিকে রয়েছে চুনাখোলা নামের আরেকটি মসজিদ। এছাড়াও মহাসড়কের পাশে রয়েছে সিঙ্গাইর মসজিদ।
পরিদর্শন
ষাট গম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ২০ টাকায় টিকেট করতে হয়। বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে প্রবেশ টিকেটের মূল্য দুইশত টাকা।
রবিবারে পূর্ণ দিন বন্ধ থাকে এবং সোমবার খোলা হয় বেলা ২.০০ থেকে। গরমকালে খোলা থাকে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শীতকালে খোলা হয় সকাল ৯টায় থেকে আর বিকেল ৫ টায় বন্ধ করা হয়। শীত ও গরমকাল উভয় সময়ই দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত কেল্লা বন্ধ রাখা হয়। তবে শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে ১২ টা ৩০ মিনিট থেকে থেকে ৩ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
যাতায়াত
ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১০টা এবং সন্ধা ৭ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত মেঘনা, বনফূল, ফাল্গুনী, আরা, পর্যটক, বলেশ্বর, হামিম ও দোলা পরিবহণের বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে সোহাগ, শাকুরা, হানিফ ও ইগল পরিবহণের গাড়ি ছাড়ে।
বাগেরহাট বাস স্ট্যান্ড থেকে রিকশা বা ইজিবাইকে করে ষাটগম্বুজ মসজিদে যাওয়া যায়।
এছাড়া ঢাকা থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে খুলনা এসে সেখান থেকে বাসে বা সিএনজি তে করে করে ষাট গম্বুজ মসজিদ যেতে পারবেন। খুলনা থেকে সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘন্টার মত।
রাত্রিযাপন
বাগেরহাটে থাকার জন্য তেমন ভাল ব্যবস্থা নেই, তবে মাঝারি মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে। রেল রোডে মমতাজ হোটেলে সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও সেবার মান তুলনামূলক ভাল, তবে খরচ একটু বেশি। এছাড়া মমতাজ হোটেলের আশেপাশে অন্য হোটেলগুলোতেও থাকার জন্য খোঁজ নিয়ে দেখা ভালো। আর বাগেরহাট থেকে খুলনা কাছে, তাই খুলনা গিয়েও কোন আবাসিক হোটেলে থাকা যাবে।
খাওয়াদাওয়া
এখানে কিছু মোটামুটি মানের খাবার হোটেল রয়েছে তাই খাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ড কিংবা দরগার কাছে হোটেলগুলোতে যাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই খাবারের মান ও দাম সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান
- বাগেরহাট জাদুঘর
- খান জাহান আলীর মাজার
- মংলা বন্দর
- নয় গম্বুজ মসজিদ
তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ এবং উইকি ভ্রমন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে
লিংক- ষাট গম্বুজ মসজিদ
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url