বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 - Bangla Pramer Golpo Ratsita
Bangla Pramer Golpo Ratsita |
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙
- বাংলা গল্পঃ 💙 রক্ষিতা 💙
- লেখকঃ তাছলিমা মুন্নি
- সংগৃহীতঃ ফেছবুক
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০১
চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে আকাশ আমার ঠোঁট কামড়ে ধরে।দু'হাতে তাকে সরাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু একহাতে সে আমার কোমরে ধরে রেখেছে। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। তবু্ও আকাশ ছাড়ছে না।একটু পরে ছেড়ে দিয়ে একহাতে আমার গালে চেপে ধরে বলে -' আকাশ চৌধুরী চাইলে তোর মতো দশটা মেয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকবে। '
এক ঝাটকায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়। একদিকে এতো জোরে গালে চেপে ধরায় আমার গাল ব্যথা করছে অন্যদিকে ঠোঁটে জ্বালা করছে,মনে হয় কেটেই গেছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।
আমার জীবনে এটা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। আজ যদি আমার বাবা-মা বেঁচে থাকতো তবে এই দিন আসতো না।এসব ভেবে চোখের জলে নিজেকে ভাসাচ্ছি।
ফোনে কথা বলতে বলতে আকাশ ঘরে প্রবেশ করে। ফোন টা রেখে বললো - 'এসব ন্যাকামি এখানে চলবে না। তোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিস, তার মাশুল সারাজীবন তোকেই দিতে হবে। '
সত্যিই বড় ভুল করেছি আমি। বাবা-মার মৃত্যুর পরে মামার অভাবের সংসারে ঠাঁই মেলে আমার। তখন আমাদের কিছুই নেই।নদী ভাঙ্গনে বাড়িঘর- জমিজমা সব হারিয়ে বাবা-মার সাথে শহরের ছোট একটা বাসায় উঠেছিলাম। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছি তখন।কত স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবো,কিন্তু ডাক্তারি পড়ার আর সামর্থ্য নেই তখন।বাবা খুব কষ্ট পেতেন কারণ ভর্তি পরীক্ষায় টিকেও ডাক্তারি পড়তে পারলাম না। আমি বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাই। আমার সান্ত্বনা মাথার উপর বটের ছায়া বাবা- মা আছে আমার। ভাগ্য আমাকে নিয়ে খেলতে শুরু করে। একদিন এক্সিডেন্টে আমার বটের ছায়ারা চলে যায় না ফেরার দেশে। তারপর মামা উনার বাসায় নিয়ে আসে।মামা এক অফিসের কর্মচারী ছিলেন। কোনোরকমে সংসার চলে যেত।দুই ছেলেমেয়ের খরচ চালিয়ে আমি তাদের উপর বাড়তি চাপ হয়ে যাই।মামা কখনো কিছু বলতেন না। কিন্তু মামী কেন চুপ করে থাকবেন?
ছুটা কাজের মহিলা বিদায় হলো। ঘরঝাড়ু,কাপড় ধোয়া,রান্না করা,বাজার করা সব একএক করে আমার উপর পড়ে। তার মধ্যে কয়েকটি টিউশনি জোগাড় করে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করি।
ক্লাসে তো যেতেই পারিনি। শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিয়ে আসি।মামি সেটাতেও আপত্তি। যতটা সম্ভব নিজের খরচ কমিয়ে টিউশনির টাকা কিছু মামির হাতে তুলে দেই।মামা সব বুঝতেন কিন্তু মামির উপর কথা বলতে পারতেন না।ঝাড়ি খেয়ে মুখ কালো করে বসে থাকতেন।
এভাবেই মামির সংসারে গায়ে খেটে পড়াশোনা শেষ করি। মামাতো ভাই - বোন সাইফ আর সুমনা, মামিকে লুকিয়ে আমার কাজে অনেক সাহায্য করতো।
কিন্তু কথায় বলে না,অভাগী যে দিকে চায় সাগর ও শুকিয়ে যায়।আমার বেলায় ও ব্যতিক্রম হয়নি।মামার অফিস থেকে একদিন ফোন আসে মামা খুব অসুস্থ, হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। মামিকে নিয়ে ছুটে গেলাম। সপ্তাহ খানেক পরে মামা বাসায় ফেরেন ঠিকই, কিন্তু প্যারালাইজড হয়ে গেছে। দুই পা অসার। মামার অফিসের কয়েকজন এসেছিলেন দেখতে। মামা অনেক বলেকয়ে মামার কাজটা আমাকে দিতে অনুরোধ করেন। ভাগ্য বুঝি মুখ তুলে চাইলো।কি দয়া হলো উনাদের, আমাকে চাকরি টা দিয়ে দিলো।
সেই অফিসের বস আকাশ।আমি মামার পোস্টেই জয়েন করি।
একদিন একটা ফাইল নিয়ে হুট করেই আকাশের কেবিনে ঢুকে পড়ি।যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এই অফিসের একটা মেয়ে আকাশের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায়!
আমি দেখেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
- হাউ ডেয়ার ইউ?!! নক না করে আমার কেবিনে ঢুকার সাহস হয় কি করে তোমার?
রাগে গরগর করতে থাকে আকাশ।
- আই এম সরি, স্যার।ভুল হয়ে গেছে।
আসলেই আমি অন্যমনস্ক ভাবেই নক করতে ভুলে গেছি।
- কোথা থেকে এসব জুটেছে কে জানে! এই মেয়ে বাবা-মা ভদ্রতা শেখায়নি? ডেইজি নামের মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো।
এই মেয়ের মুখে ভদ্রতার কথা শুনে গা রি রি করছে আমার।আমার ভুল আমাকে আরও কিছু বললেও মেনে নিতাম, কিন্তু আমার বাবা-মাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি সহ্য করতে পারি না।
- এক্সকিউজ মি মেম, আমার ভুল হয়েছে আমি স্বীকার করছি।কিন্তু তাই বলে আপনি আমার মা- বাবাকে তুলে কথা বলতে পারেন না।আর ভদ্রতা কাকে শেখাতে হবে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি!
- ইউ ইডিয়ট!
ডেইজি আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলতেই ওর হাত ধরে ফেলি।
- Don’t dare you! এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে দেই।আমার ব্যবহার ডেইজি বোকা হয়ে গেছে। ভাবতেও পারেনি এমন টা করতে পারবো।
আকাশ এতো সময় শুনছিলো।এবার এগিয়ে আসে -
' এই মেয়ে তোমার তো খুব সাহস দেখছি!'
- স্যার আপনার মিটিং এর ফাইল রেডি।এক্সকিউজ মি!
ফাইল টা ডেস্কে রেখে আমি বেরিয়ে আসি।
মাস খানেক কেটে যায়। ডেইজি আমার পেছনে লেগেই আছে। আমি সতর্ক থাকি যাতে আমার ভুল ধরতে না পারে।আকাশ সেদিনের পর আমাকে কিছু বলেনি।কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার পোস্ট পরিবর্তন করা হয়।আগে মামার পোস্টে থাকলেও এখন আমি আকাশের পি.এ.।
আকাশের পাশের কেবিন টা আমার।
এদিকে মাসের শেষে অফিসে একটা পার্টির আয়োজন করা হয়। পার্টি চলাকালীন আমি এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকি।এসবে আমি অভ্যস্ত নই।
হঠাৎ খেয়াল করলাম সকলের মধ্যমণি আকাশ নেই।
কিছুক্ষণ পরেই আকাশের ফোন। একটা জরুরি ফাইল নিয়ে কেবিনে যেতে বলে।
নক করে কেবিনে ঢুকে দেখি আকাশ চেয়ারে নেই।কেবিন টার একপাশে বসার জন্য আলাদা যায়গা আছে। তার পাশের জানালার কাছে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে।
- স্যার, ফাইল।
- টেবিলে রাখো।
রেখে চলে যাচ্ছি তখন আকাশ পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। আমি ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়াই।আকাশ একদম কাছে চলে এসেছে আমার।
তার চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। পার্টিতে ড্রিংকস করেছে অনেক। হাত ছাড়াতে পারছি না।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০২
- স্যার! হাত ছাড়ুন।
- কোথায় যাচ্ছো? এতো তাড়া কিসের?
আকাশের ব্যবহার আমার ভালো লাগছেনা। অস্বস্তি বোধ করছি।
- আমার কাজ আছে। হাত ছাড়ুন।
- তুমি আমার পি.এ। আমি যা বলবো তুমি তা-ই করবে। সবাই আকাশ চৌধুরীর কাছে ভিড়তে চায় আর তুমি কেন দূরে থাকো?
আকাশ আমার সামনের এলোমেলো চুল আঙুল দিয়ে ঠিক করে দেয়।
আকাশ স্বাভাবিক নয় মাতলামি করছে বেশ বুঝতে পারছি।
- হাত ছাড়ুন বলছি!
আমি আরও জোর করতে থাকি।
এবার আকাশও হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে আমাকে। ভয়ে আমার হাত-পা জমে আসে। আকাশ ক্রমশ তার মুখ এগিয়ে আনে।কি করবো বুঝতে না পেয়ে আচকা একটা ধাক্কা দিয়ে আকাশের হাত সরিয়ে দেই। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেই আকাশের গালে।
আকাশ প্রথমে বুঝতে পারেনি ঠিক কি ঘটেছে। একটু সময় নিয়ে বললো - এই মেয়ে! তুই আকাশ চৌধুরীর গালে চড় দিয়েছিস!! আকাশ চৌধুরীর!?
এর মাশুল তোকে দিতে হবে। অনেক বেশি ভারী পড়ে যাবে!
আমি বের হতে যাই কেবিন থেকে, কিন্তু আকাশ আমার হাত ধরে একটানে দেয়ালের চেপে ধরে আমার ঠোঁটে অসম্ভব রকমের বন্য হয়ে কিস করে। অনেক ধস্তাধস্তির পর ধাক্কা সামলাতে না পেরে আকাশ তার ডেক্সের উপর পড়ে যায়। সাউন্ড-প্রুফ কেবিন হওয়ায় বাইরের কারো কানে আমার আওয়াজ পৌছায়নি। আর এমনিতেই সবাই পার্টিতে ব্যস্ত!
আমি দৌড়ে বেরিয়ে আসি কেবিন থেকে। অফিসে আর এক মুহূর্ত ও থাকিনি।সরাসরি বাসায় ফিরে আসি। সারাটা রাস্তা কেঁদে চোখ ফুলে গেছে।
মামার এই অবস্থা! চাকরি টা চলে গেলে সংসার কিভাবে চলবে? আর আকাশের অফিসে কাজ করাও সম্ভব না। কি করবো চিন্তা করতে পারছি না। এদিকে সাইফ - সুমনার কলেজের বেতন দিতে হবে।
ভাগ্য আমার দিকে মুখ তুলে তাকায় নি, বরং জমের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আকাশ চৌধুরীর অনেক ক্ষমতা। দেশের নামী শিল্পপতির মধ্যে অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি।উনার যা ইচ্ছে তা ই করতে পারেন।
পরের দিন অফিসে যাইনি। এরপরদিন যেতে ইচ্ছে না করলেও যেতে হলো। ভাগ্য ভালো সেদিন আকাশ অফিসে ছিলো না। আমাকেও ফোন দেয়নি।
বিকেলবেলায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি। বাসায় ঢুকতেই সুমনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
- কি রে কি হয়েছে?
- আপু আগে হা করো, মিষ্টি খাও তারপর বলছি।
জোর করে মুখে একটা মিষ্টি ঢুকিয়ে দেয়।
মিষ্টি খেতে খেতে বললাম - কিসের মিষ্টি? তোর তো আজকে কোনো রেজাল্ট দেবার কথা নয়,তবে ?
- একটা সুখবর আছে। আমরা সবাই অনেক অনেক খুশি।
- কি সুখবর?
- আপু,তোমার রাজ কপাল! এতো বড় ঘরে তোমার বিয়ে হবে! ইস! আমার যে কি খুশি লাগছে।।
- বিয়ে? আমার? কি বলছিস এসব?
- হুমম। এটা তো সারপ্রাইজ তোমার জন্য।
তুমি ভাবতেও পারবে না কোথায় বিয়ে হচ্ছে।
- তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। মামি কোথায়?
মামি... মামি...
আমি মামির ঘরে গেলাম।
- কাজল, আয় ভেতরে আয়।
মামির মোলায়েম কণ্ঠস্বর কোন আগাম ঝড়ের সংকেত দিচ্ছে বুঝতে পারছি না।
- কি হয়েছে মামি?
- তোর কি ভাগ্য! নইলে এমন ঘরের বউ হবি কল্পনা করা যায়??
মামির সামনে ছোট-বড় অনেক গুলো গিফট বক্স আর একটা চেক পড়ে আছে।
- কে এনেছে ওগুলো?
- তোর হবু বর নিয়ে এসেছে। ছেলেটা খুবই ভালো।
- কে এসেছিলো বলবে তো?
- আকাশ,তোর অফিসের বস।তোকে বিয়ে করতে চায়।
- কি বলছো এসব মামি? এটা কি করে সম্ভব?
- অসম্ভবের কি আছে? তোকে ভালো লেগেছে তাই বিয়ে করতে চায়।
- মামি,এ বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর মামার এই অবস্থায় আমি না থাকলে সংসার চলবে কিভাবে?
- সে চিন্তা তোকে করতে হবে না। আকাশ সব ব্যবস্থা করে দিবে।
- ব্যবস্থা করে দিবে মানে?
- সাইফ, সুমনার পড়ার খরচ, সংসার খরচ,তোর মামার চিকিৎসার সব খরচ আকাশ দিবে।
- আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? মামি,আমাদের কি আত্মসম্মানবোধ নেই? আকাশ চৌধুরীর টাকায় কেন আমাদের চলতে হবে?
এটা কিছুতেই সম্ভব না।
- আত্মসম্মানের.... ( মামি গালিগালাজ করেন), বিছানায় পড়ে একজন কাতরায়,এতো মানুষের খরচ কোথা থেকে আসবে? তোর বাপ এসে দিয়ে যাবে?
- মামি,কতবার বলেছি বাবা-মা তুলে কথা বলবে না। সংসার আমি চালাবো। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
মামিকে আর কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে চেক নিয়ে বেরিয়ে আসি।
আমি বুঝতে পারছি না আকাশ কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। লোকটার প্রতি ঘৃণা ছাড়া কিছু আসেনা। হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। এদিকে মামি আমার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। আমি চুপচাপ শুনছি।মামির সাথে কথা বললেই ঝামেলা বাড়বে।
পরদিন অফিসে যাই।আকাশের কেবিনে গিয়ে দেখি ফোনে কথা বলছে।
আমাকে দেখে ফোন রেখে দিলো।
- আরে কাজল এসো, এসো।
চেকটা সামনে রেখে বললাম - এসব কি?
- কেন? তোমার মামি তোমাকে কিছু বলেনি?
- সেইজন্যই জিজ্ঞেস করছি এসবের মানে কি?
- মানে খুবই সিম্পল! তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
- কেন চাইছেন জানতে পারি?
- তোমাকে ভালো লাগে তাই।
- এটা যে আসল উদ্দেশ্য নয় সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
- স্মার্ট গার্ল!
- দেখুন, এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
- বিয়ে তো তোমাকে করতেই হবে। আর সেটাও এক সপ্তাহের মধ্যে।
- অসম্ভব। কিছুতেই না। প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিবো।
- গ্রান্টেড হবে না। সো গেট রেডি।
আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
আর যাই হোক এই লোকটাকে বিয়ে করা সম্ভব না। চেক টা টেবিলে রেখেই চলে আসি।
স্যালারির তুলতে হবে। মামার অসুস্থতায় বেশ কিছু টাকা ধার করতে হয়েছে। এদিকে সাইফ - সুমনার কলেজের বেতন, টিউশন ফি দিতে হবে, মামার ঔষধ ফুরিয়ে গেছে প্রায়।
বিল তুলতে গিয়ে দেখি আমার স্যালারি আসেনি। আমার বিল পেপারে সাইন করা হয়নি।
জিজ্ঞেস করতে তারা জানায় - ' স্যারের নিষেধ আছে, অনুমোদন করতে হলে স্যারের অনুমতি লাগবে। '
রাগে দুঃখে চোখে পানি চলে আসছে। সারা মাস খেটে বেতন টাও পেলাম না।
আবার গেলাম আকাশের কেবিনে। আকাশ নেই।আমি আকাশের পি.এ. হলেও গত দুই-তিন দিন আমাকে তেমন কোনো কাজ করতে দেয়া হয়নি।আকাশ একাই বের হয়ে যায়।
বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর আকাশ আসলো।
- স্যার
- হুম, বলো।কি সিদ্ধান্ত নিলে?
- স্যার, আমার বেতন আটকে আছে। আপনি অনুমতি না দিলে অনুমোদন দিবে না।
- হবে না। যতক্ষণ আমার প্রস্তাবে রাজি না হচ্ছো, বেতন আটকে থাকবে।
- আপনি এটা করতে পারেন না স্যার! এটা আমার প্রাপ্য।
- সো হোয়াট?আকাশ চৌধুরী চাইলে পাবে, নইলে পাবে না।
- এভাবে আমার স্যালারি আটকে রাখলে আমি আইনি ব্যবস্থায় যাবো।
- হাহাহা.... জোকস টা,ভালো ছিলো!
- স্যার, আমি কোনো জোকস বলিনি!আপনারা আমার স্যালারি বিনা কারণে আটকে রাখতে পারেন না!
- আমি আটকে রাখবো। আইনি ব্যবস্থা নাও!
মুখে বললেও আমি জানি আইনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবো না। উনাদের টাকার কাছে সব বিকিয়ে যায়!
- প্লিজ স্যার, এমন টা করবেন না। আমার মামা খুব অসুস্থ।
- সেই জন্যই তো বলছি রাজি হয়ে যাও।।
আমি আকাশের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসি। হাত-পা ভেঙে আসছে। বেতন পেলাম না। বাসায় এসে দেখি টেবিলে কারেন্ট বিলের,পেপার বিলের,ডিসের বিলের কাগজ রাখা। মামি এসে বললেন - তোর মামার ঔষধ আনতে হবে, আজ খাওয়ালেই শেষ হয়ে যাবে।
সুমনা এসে বললো - আপু পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য টাকা লাগবে।
- কত লাগবে?
- পাঁচ হাজার আর সাথে বেতন, টিউশন ফি। সব মিলিয়ে এগারো হাজার।৭ তারিখের মধ্যে দিতে হবে।
- আচ্ছা দিয়ে দিবো।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিভাবে দিবো এতো টাকা!
কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। অনেক যায়গায় গেলাম কিন্তু কেউ ধারও দিলো না। সবার কাছে তো ধার চাইতেও পারিনা। যাদের কাছে পারি তারা আগেই দিয়েছে, সেগুলোই শোধ হয়নি।তাও একজন কিছু দেয়ায় মামার এক সপ্তাহের ঔষধ নিয়ে বাসায় ফিরি।
কিন্তু... সারারাত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম আকাশ কে বিয়ে করবো। যা আছে আমার কপালে! আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৩
স্যার, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি!' পরদিন অফিসে গিয়েই আকাশকে বলে দিলাম।
-That's like a good girl !! আমি জানতাম তুমি রাজি হবেই।যাইহোক তুমি প্রিপারেশন নাও।আমি আজই তোমাদের বাসায় যাবো।
আকাশের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় নেই আমার। সাইফ-সুমনার পড়াশোনা, মামার চিকিৎসা সব বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি জানিও না কেন আকাশ আমাকে বিয়ে করতে চাইছে! কি উদ্দেশ্য তার? আকাশের মতো ক্ষমতাবান কোটিপতি লোক যখন আমার মতো অতি সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তার পিছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। এক-ভালবাসা, দুই- অন্য কোনো উদ্দেশ্য!
এক নাম্বার টা হবার কোনো চান্সই নেই সেটাও আমি ভালো করে জানি। দুই নাম্বার টাই ঠিক।কিন্তু কি উদ্দেশ্য সেটাই বুঝতে পারছি না।
উদ্দেশ্য যাইহোক আমার উদ্দেশ্য ঠিক থাকলেই হবে। আমার শর্তগুলো পূরণ করতে হবে, তবেই বিয়ে করবো।
সন্ধ্যায় আকাশ বাসায় আসে, সাথে অনেক কিছু নিয়ে আসে। সবার জন্য কাপড়-চোপড়,মিষ্টি আরও অনেক কিছু।
মামার জন্য হুইলচেয়ার। মামাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ড্রয়িং রুমে আনা হয়। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসে।কতদিন মামা বিছানা থেকে উঠেনি। হুইলচেয়ার কেনার মতো অবস্থা ছিলো না,অন্যান্য খরচ চালাতেই হিমসিম খেয়েছি।তার উপর টিউশনি ছেড়ে চাকরিতে ঢুকেছি,কিন্তু সারামাস হাতে কিছুই ছিলো না।
আকাশ মামা-মামীর সাথে কথা বলে। মামার একাউন্টে এখানে বসেই অনেকগুলো টাকা ট্রান্সফার করে দেয়, যাতে মামার চিকিৎসার আর সংসার খরচ ভালো ভাবেই চলে। সাইফ- সুমনার হাতে একটা চেক তুলে দেয় তাদের পড়াশোনা খরচ। মামা আপত্তি করলেও মামীর চোখ রাঙানিতে চুপ হয়ে যায়।
কিন্তু আমার তো কিছু বলার আছে।
- স্যার,অনেক কিছুই তো দিলেন। কিন্তু দুদিন পরে? কে দেখবে সংসার? সাইফের পড়াশোনা শেষ হতে সব মিলিয়ে বছর খানেক লাগবে।ততদিন? '
আমি নির্লজ্জের মতো বলে ফেললাম। লজ্জা করে কি হবে? সেইতো উনাদের জন্য বিয়ে করবো, তবে উনাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে কেন নয়?
- কাজল,সে সব তোমাকে ভাবতে হবে না। সাইফের পড়াশোনা শেষ হবার আগ-পর্যন্ত আমি সব দায়িত্ব নিলাম।এই নাও এগ্রিমেন্ট পেপার।
আর ওর পড়া শেষ হলে চাকরি আমি ওকে দিবো।
আকাশ আমার হাতে এগ্রিমেন্ট পেপার তুলে দেয়।
মামার চোখে পানি- স্যার আপনি এতো কিছু করলেন, আবার এগ্রিমেন্ট পেপার কি প্রয়োজন? আপনার উপর আমাদের বিশ্বাস আছে।
- আপনার থাকতে পারে, আপনার ভাগ্নির তো নাও থাকতে পারে।
তো মিস. কাজল আপনার আর কোনো আপত্তি আছে?
- জি না।আর কোনো আপত্তি নেই।
ঠিক হলো দুদিন পরেই বিয়ে,তবে সেটা ঘরোয়া আয়োজনে করতে চায়।মামা-মামী তাতেও রাজি হয়ে গেলেন।ভাবলেন আমাদের খরচ বাড়তে চায় না, তাই এভাবে বিয়ে করতে চাইছেন।
পরদিন আমার গায়ে হলুদ দিলো।আকাশ বিয়ের শাড়ি-গয়নাসহ যাবতীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলো।
তারপর দিন বিয়ে হয়ে গেলো। কাজি,ইমাম আর আকাশ ছাড়া কেউ আসেনি।আমার পরিবারের কয়েক জন আর আমার কাছের বান্ধবী ইরা ছাড়া কাউকে কিছু বলা হয়নি।
আকাশের বিয়ে অথচ ৫-৬ জন মানুষ ছাড়া কেউ জানলো না!
বিয়ের পর আকাশ আমাকে ওর বাসায় নিয়ে আসে। আমি জানি না আকাশের বাড়ি কেমন। কে কে আছে বাড়িতে। উনার বিয়ের বিষয়ে কেউ কিছু জানে কিনা।জানলে বিয়েতে যায়নি কেন।আর যদি না জানে তবে কিভাবে রিয়েক্ট করবে??
হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায়।ভাবতে ভাবতে এক বিশাল বাড়ির সামনে এসে গাড়ি হর্ন দেয়।গাড়ির হর্নে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। বিশাল গেইট খুলে যায় আর গাড়ি ভেতরে ঢুকে। ভেতরে দেখে আমার চোখ কপালে!
এতো বিশাল এরিয়া জুড়ে অনেক বড় দুইটা বাগান। বাগানের দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ- গাছালি। বেশ ভিতরে বাড়িটা যেন রাজ- প্রাসাদ!
আকাশ গাড়ি থেকে নেমে বলে - বেরিয়ে এসো।
আমি ভয়ে ভয়ে বের হয়ে এলাম গাড়ি থেকে। একজন লোক এসে গাড়ি থেকে আকাশের ব্রিফকেস নিয়ে যায়।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে।
আকাশ দরজায় পা দিতেই সব কাজের লোকেরা দুপাশে ভাগ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে যায়।এটা হলরুম না ড্রয়িং রুম! এযে রাজ প্রাসাদ!
একজন ছুটে গিয়ে একটা ট্রেতে করে ঠান্ডা পানি,কয়েক ধরনের জুস নিয়ে আসে।
আকাশ পানির গ্লাস টা নিয়ে শুধু পানি টুকু খায়।
এদিকে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। অথচ কেউ আমাকে পানিও দিলো না!
- এসো আমার সাথে।
আকাশ আমার হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে যায়।
রুমে গিয়েই
চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে এই কান্ড ঘটনায়! বাড়িতে এসেই এতো দিনের জমানো ঝাল আমার উপর ঝাড়লো।
বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে মানুষের। স্বপ্ন দেখে একটা মানুষকে নিজের করে পাওয়ার,একটা মানুষের কাছে নিজেকে সপে দেয়ার! আমি এসবের কিছু করছি না। আমি নিজেকে আকাশের হাতে সপে দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে আসিনি।আকাশের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি।এই পৃথিবীতে আমার কাছের বলতে যে মানুষগুলো আছে, তাদের সুখের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি!
এসব ভাবনা ফেলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। একটু পরেই আমার জন্য রুমে খাবার আসলো। নানা ধরনের খাবার, অনেকগুলোর নামই জানি না। আমি শুধু একটু পানি খেয়েছি। গলা দিয়ে খাবার আমার নামবে না।
এমন সময় আকাশও এসে দেখে কিছুই খাইনি।
- খাওনি কেন?
- খিদে নেই।
- খিদে না থাকলেও খেতে হবে। না খেয়ে অসুস্থতার বাহানায় অফিস কামাই করা যাবে না!
আমি আগে জানতাম না বিয়ের পর আকাশ চাকরি টা করতে দিবে কিনা,তবে এবার তার কথা শুনে নিশ্চিত হলাম যে চাকরি করতে পারবো।
- খেয়ে নাও।
- খাবার তো আমার ইচ্ছেতে খাবো, সেটাতেও কি আপনার অর্ডার মানতে হবে?
- অবশ্যই হবে। কাগজে এমনটাই লেখা আছে,?
- কিসের কাগজ?
- কাবিননামা! সেখানে কি লেখা আছে জানো না?
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৪
কাবিননামায় লেখা আছে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, সজ্ঞানে আগামী ২ বছর আমার স্ত্রী হিসেবে থাকবে এবং আমার প্রত্যেক আদেশ মানতে বাধ্য থাকবে।'
- কি বলছেন এসব? কাবিননামায় এসব লেখা থাকে নাকি? আর কালিমা পড়ে তো বিয়ে করেছেন।
- হা করেছি আর সাথে কাগজেও উল্লেখ আছে, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারবো। তুমি পারবেনা।তবে বিয়ে তো হয়েছে!
আকাশের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। কন্ট্রাক্ট মেরিজ! এইভাবেই শোধ নিলো! একটা চড়ের?
- কেন করছেন আমার সাথে এসব? কি এমন ক্ষতি করেছিলাম আপনার!?
- তুমি আকাশকে এখনো চেনোনি।চিনবে ধীরে ধীরে! দুই বছর অনেক সময়। এরমধ্যে ভালো করেই চিনবে।
এইবার খেয়ে নাও।
- খিদে নেই, খাবো না।
আকাশের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
- এক্ষুণি খেতে বলেছি, তো খাবে।
- না!
- কি!! আমাকে না করিস? তুই খাবিনা তোর ঘাড় খাবে।
আকাশ একটা পাউরুটি নিয়ে জোর করে আমার মুখে ঠেসে দেয়!
এতো বদমেজাজি মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তার চেয়ে আমার মামি হাজার গুণ ভালো।
রাতে আকাশের সাথে একই বিছানায় শুতে আমি বেশ ইতস্তত বোধ করছি।এই খাটাশ বেটা তো একটা লুইচ্চা! আমি খাটে বসে আছি। শুবো? নাকি বসে থাকবো? ভাবছি....
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আকাশ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে সোজা বিছানায়!!
- আরে কি করছেন? ছাড়ুন বলছি! ছাড়ুন!
- ছাড়ার জন্য তোমাকে এনেছি?
তারপর চারদেয়ালে বন্দি এই ঘরে যা ঘটে গেল তা আমাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনের অনেক কাঙ্ক্ষিত একটা সময় হচ্ছে বাসর।নারী- পুরুষের মিলন এটা প্রকৃতি বেঁধে দিয়েছে। বিবাহ নামক শব্দে যার বৈধতা নিশ্চিত করা হয়। বিবাহের বাইরে ও অনেক ভাবেই সেটা হয়ে থাকে। কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো অনিচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত ভাবে জোর করে যেটা হয় সেটারও একটা নাম আছে - ধর্ষণ।কিন্তু আমাদের সমাজে কখনো এটা শেখানো হয়নি যে স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করাও ধর্ষণ! তাই শতকরা ৯৯% মহিলারাই এটা জানে না। তারা এটাকে স্বামীর অধিকার হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু আমি?
আমি কি করবো? ২ বছরের জন্য বিয়ে করা হয়েছে। বউয়ের স্বীকৃতি কি পেয়েছি? এই সমাজ কি আমাকে বউ বলে মানবে? আমিতো নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি।তাই আকাশের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচানোর সবচেষ্টা ব্যর্থ হলে, রাগে,দুঃখে,আর শারীরিক যন্ত্রণায় চোখ ভাসিয়েছি। সেসব কিছুই আকাশকে স্পর্শ করেনি।
কোনোরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেই। শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে থাকি প্রতিটি স্পর্শ মুছে দিতে। আমার কান্না এই চার দেয়ালে আটকে আছে। কত সময় ভিজেছি জানি না।দরজায় একটার একটা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আকাশ।
আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে আসি। আকাশ অপলক চেয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে কিছু একটা আছে - তা আমার চোখ এড়ায় নি। কিন্তু কি আছে আমি বোঝার চেষ্টা করছি না। তবে এই দৃষ্টিতে এখন কাম নেই, সেটা বুঝতে না চাইলেও নারীর চোখ এড়ায় না।কি আছে আকাশের চোখে? প্রেম? নাকি অপরাধ বোধ?
আকাশের চোখে যাই থাকুক না কেন, আমার চোখে আছে একরআশ ঘৃণা!
- সরি।
খুব ক্ষীণস্বরে বললো আকাশ।
'সরি' তোর সরির গোষ্ঠী কিলাই! বজ্জাত! লুইচ্চা! খাটাশ!
আমি কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। মুখফুটে গালিও না।চুপচাপ শুয়ে পড়ি।
আকাশ বসে আছে। কিছু সময় বসে থেকে আকাশও শুয়ে পড়লো। আমি নীরবে কেঁদেই যাচ্ছি।
পরদিন সুমনা আর আমার বান্ধবী ইরা আসে।ওদের দেখে আমি খুব খুশি হই।সুমনা তো ভীষন খুশি। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলো।
- আপু,এ দেখছি রাজপ্রাসাদ!আসলেই তোমার রাজ কপাল।সেজন্যই আকাশ ভাইয়ের মতো স্বামী পেয়েছো,একেবারে রাজপুত্র।
সুমনার কথা শুনে আমি মৃদু হাসি।কি করে সুমনা বলি এ আমার প্রাসাদ না,এ আমার জন্য নরক।
তখন ইরা বললো - কিরে, কেমন কাটলো বাসর?
- ধুর!
- ধুর কি? তোর জামাই খুব রোমান্টিক তাইনা?
- কিসব যাতা বলছিস।
- হুমম। যা দেখছি তাই বলছি।
- মানে? কি দেখছিস?
ইরা মুখটিপে হাসছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
- কি দেখেছিস?
- অইযে তোর গলায় রোমান্সের চিহ্ন!
বলেই ইরা, সুমনা একসাথে ফিক করে হেসে উঠে। লজ্জায় আমি কাচুমাচু করে গলায় হাত দিলাম। নেকলেসের ঘসা লেগে ছিলে গেছে। কাল বুঝতে না পারলেও সকাল থেকে জ্বালা করছে। কিন্তু সেটা যে ইরার চোখে পড়বে কে জানতো!
আমি বললাম - ধ্যাৎ, এটা নেকলেসের ঘষা খেয়ে ছিলে গেছে। কিন্তু ইরা... তোর জামাই খুবই...ই রোমান্টিক হবে।
- ওমা তাই? ইসস.. হাউ সুইট! ইরা খুবই আহ্লাদিত।
- তবে একটা কি জানিস? বিয়ের আগে যারা লুইচ্চা থাকে, অই বেটারাই বিয়ের রোমান্টিক নাম নেয়!
বলে আমি মুখটিপে হাসছি।
ইরা চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই আকাশ হাজির।
- আরে আমরা শ্যালিকারা দেখি হাজির।
- জি আমরা হাজির। আমার বান্ধবীকে নিয়ে আসছেন। এখন আপনাদের ধরে নিতে আসছি।
- হুম। বুঝলাম।কিন্তু সমস্যা একটা আছে।
- কি সমস্যা?
- আসলে অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে। আজকে তো যেতে পারবো না।কাল শুক্রবার। তোমরা আজকে থাকবে, কাল একসঙ্গে যাবো।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
ইরা আর সুমনা থেকে গেল। আজ আকাশ খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। ওদের সাথে অনেক গল্প করলো। আমি আগের আকাশ আর আজকের আকাশের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। কত রূপ এই মানুষটার??
পরদিন মামার বাসায় গেলাম। আকাশও সারাদিন আমাদের সাথেই ছিলো। মামার সাথে আলাদা কথা বলবো সেই উপায় নেই। আকাশ ভাবছে হয়তো আমি কিছু জানিয়ে দিবো।তাই কিছুতেই একা ছাড়ছে না।
আমি তো এমনিতেই কিছু বলবো না। সবাই ভালো থাকুক।বলে কি হবে? সবাই অযথা চিন্তা করবে, মামা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি তখন আকাশকে বললাম - চিন্তা নেই। কাউকেই কিছু বলবো না।
একটু হেসে আকাশ বললো - আমি জানি তুমি বলবে না।কিন্তু সবাই বুঝুক আমি কত বউ পাগল!
আমি অবাক চোখে দেখছি।
- আপনি আসলে কি আমি বুঝতে পারিনা। অদ্ভুত মানুষ!
আমার রুম আকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে ঘুরে দেখে।আমার প্রতিটি শখের জিনিস দেখে।
আমার অনেক শখের একটা ছোট্ট লাইব্রেরী আছে। টিউশনির টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছু বই কিনতাম। আকাশ আমার বইগুলো দেখছে।
- শেক্সপিয়র থেকে শুরু করে নজরুল, হুমায়ুন... বাহ! বেশ ভালো তো! তুমি তো অনেক বই পড়তে পছন্দ করো দেখছি!
আবার কবিতার বইও দেখছি!
এই,তুমি কি কবিতাও পড়ো নাকি?
- হা পড়ি।কেন?
আকাশ কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
- তুমি... সিরিয়াসলি তুমি কবিতা পড়ো?
- হা,বললাম তো পড়ি। কেন কি হয়েছে তাতে?
- এ যুগের মেয়ে হয়েও তুমি কবিতা পছন্দ করো সেটাই অবাক লাগছে।
- অবাক হবার কি আছে? সবার পছন্দ তো এক রকম হয় না।আমি শেক্সপিয়র পড়েছি,ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি,জন ডন,ফ্রস্ট পড়েছি ; উনাদের পড়ে যত মুগ্ধ হয়েছি; রবীন্দ্র- নজরুল, শরৎচন্দ্র পড়ে মোহিত হয়েছি।
ওসব আপনি বুঝবেন না।কারণ আপনার আমার পৃথিবী আলাদা।আমাদের দুই পৃথিবী।
আকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো আমার কথা।
অফিসের ব্যস্ততা দেখিয়ে বিকেলেই আকাশ আমাকে নিয়ে ফিরে আসে।
আকাশে আজ মেঘ করেছে,তার সাথে বেশ শীতল করা বাতাস।
শেষ বিকালে আমি ছাদে চলে আসি।হাতের মোবাইলে পছন্দের একটা গান প্লে করে পাশে রেখে আকাশে মেঘ দেখছি।
"মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর
মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়,
ব্যাকুল হলে তিস্তা।
মন খারাপের খবর আসে
মন খারাপের খবর আসে
বন পাহাড়ের দেশে
চৌকোনো সব বাক্সে
যেথায় যেমন থাকসে
মন খারাপের খবর পড়ে দাড়ুন ভালবেসে।
মেঘের ব্যাগের ভেতর ম্যাপ রয়েছে মেঘ পিওনের পাড়ি
পাকদন্ডী পথ বেয়ে তার বাগান ঘেরা বাড়ী।
বাগান শেষে সদর দুয়ার,
বারান্দাতে আরাম চেয়ার
গালচে পাতা বিছানাতে ছোট্ট রোদের ফালি
সেথায় এসে মেঘ পিয়নের সমস্ত ব্যাগ খালি"
...
......
আকাশ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।ওকে দেখেও কিছু বললাম না।
- খুব সুন্দর তো!
- কি?
- কি সুন্দর বাতাস মেঘ কেটে কেটে যাচ্ছে, তার সঙ্গে এমন একটা গান! বেশ অন্যরকম।
- আগে কখনো মেঘ দেখেননি বুঝ?
- দেখবো না কেন? তবে এভাবেও দেখা যায় জানতাম না।
- হুম। আমি দেখি।আকাশে মেঘ করলে বেশ আয়োজন করে মেঘ দেখি।
এমন সময় আকাশে একটা ফোন আসে।
- হ্যালো
কি কথা হলো বুঝতে পারলাম না। আকাশ ফোন টা রেখে দিলো। কিন্তু ওর চোখমুখে ভয়ংকর একটা কিছু দেখতে পাচ্ছি। আকাশ এখানে দু'মিনিটের বেশি আর দাঁড়িয়নি।চোখমুখ লাল করে চলে যায়। আমি হঠাৎ ওর এমন চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেছি।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৫
আমি হঠাৎ ওর এমন চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেছি। ফোনটা আসার পর আকাশের চোখেমুখে ভয়ংকর ক্রোধ দেখেছি। এরপর সারা সন্ধ্যা আকাশকে কোথাও দেখতে পাইনি। অদ্ভুত একটা মানুষ আকাশ। কখন ভালো করে কথা বলে, কখন চট করে রেগে যায় বোঝা দায়।
এই বাড়িতে আসার পর আকাশের পরিবারের কোনো লোকজন, কাউকে দেখিনি। অনেক গুলো কাজের লোক আছে। তারাও আমাকে দেখে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকে। আকাশকে যে জিজ্ঞেস করবো ওর পরিবারে কে আছে, সে সুযোগ ও হয়ে উঠেনি।
বেশ রাতে আকাশ ফিরে আসে। আমি রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন টলতে টলতে আকাশ রুমে ঢুকে। টাল সামলে না পেরে পড়তে গিয়ে আমার উপরে ঢলে পড়ে। ধরে নিয়ে বিছানায় কোনোরকমে শুইয়ে দিয়ে আমি চলে আসবো, তখন আমার হাত টেনে ধরে বললো - কোথায় যাচ্ছো? এসো।
কি পরিমাণ ড্রিংকস করেছে কে জানে!আমি কিছুতেই হাত ছাড়াতে পারছি না। উল্টো টানাটানি করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে তার উপরে পড়ে গেছি।মদ্যপ অবস্থায় আকাশ কতটা হিংস্র হতে পারে তা খুব করে বুঝলাম।
মনে তীব্র কষ্ট নিয়ে তার পাশবিকতা দেখলাম। নিয়তি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না,তবে এটা জানি যে, আকাশের হাতের পুতুল করে দিয়েছে।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে আকাশ অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। সকাল থেকে কোনো কথাই বলেনি আমার সাথে। রেডি হতে হতে বললো - 'তোমার আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। দুদিন পর থেকেই যাবে। রেস্ট নাও। '
আমি শুধু চেয়ে দেখলাম,কিছু বললাম না।
দুদিন পর আমি অফিসে আসি আকাশের সাথেই। অফিস আসলাম, কিন্তু একটা অস্বস্তি বোধ করছি।আমি বুঝতে পারছি আমার চারপাশে আড়ালে কানাঘুঁষা চলছে। দু'একটা কথা যে কানে আসেনি তাও নয়।
আকাশের কেবিনে যাচ্ছিলাম, কে যেন নিচুস্বরে বলছে
- এসেই স্যারকে তো হাত করে নিয়েছে।
- ঠিক বলেছেন। দেখে তো মনে হয় না ভাজা মাছ উল্টাতে পারে। আজ দেখলাম স্যারের গাড়ি করে এসেছে! '
আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে আসি।মনটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে কত সমালোচনা চলছে।
ফেরার সময়ও আকাশের গাড়ি করেই ফিরতে হলো।
পরদিন অফিসে যাবার আগে আকাশকে বললাম - আমি আপনার সাথে যাবো না। আপনি চলে যান।আমি অন্য গাড়িতে চলে যাবো।
আকাশ একটু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো - কেন? কি সমস্যা?
- সমস্যা কিছু না।
- কেউ কি কিছু বলেছে?
- কেউ কিছু বলেনি।তবে প্রতিদিন আপনার একজন পি.এ আপনার গাড়ি করেই যাবে-আসবে, সেটা তো দৃষ্টিকটু হবেই।
- দেখো কাজল,তুমি চাকরি টা এখন না করলেও পারো,তোমার যা প্রয়োজন, যত টাকা প্রয়োজন নির্দ্বিধায় নিতে পারো।কিন্তু আমি চেয়েছি তুমি চাকরি টা করো তোমার নিজের জন্য।না করতে চাইলেও জোর করবো না।
তবে অফিসে যেতে হলে আমার সাথেই যাবে।'
অগত্যা ওর সাথেই গেলাম।
ডেইজির চোখ থেকে ঘৃণা আর আগুন বের হয় সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। অফিসে অন্যকেউ কিছু বলার আগে সেই কথা ডেইজি সবার কানে পৌঁছে দেয়।আর পৌঁছাবেই না কেন? তার পোস্ট টা আকাশ আমাকে দিয়েছে।চাইলেই আর যখন তখন আকাশের কেবিনে যেতে পারছেনা।
কিন্তু পরদিন অফিসে এসে দেখি আমার কেবিনে অন্য একটা মেয়ে।
আমি ঢুকতেই সালাম দিয়ে বললো
- ম্যাম, আমি তুলি, আকাশ স্যারের পি.এ.।আপনি আসুন আমার সাথে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটা অন্য একটা কেবিনে নিয়ে যায় আমাকে।
- মেম, আজ থেকে আপনার কেবিন এটা।
- আমার কেবিন মানে?
-আজ থেকে আপনি কোম্পানির জি.এম.। তাই নতুন কেবিন আপনার জন্য।
মেয়েটা খুব হাসিখুশি। দেখে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। তুলি হাসিমুখে বেরিয়ে যায়।
আকাশ কি শুরু করেছে এসব।এমনিতেই নানান কথা উঠছে, তার উপর এখন এই কাজ করলো! সবাই কি ভাবছে কে জানে।
আমি সাথে সাথেই আকাশের কেবিনে যাই।
- কি শুরু করেছেন আপনি?
- কি করেছি?
- জি.এম. করেছেন আমাকে? মানুষ কি ভাববে ভেবে দেখেছেন?
- কে কি ভাবলো তাতে আকাশের কোনোদিন কিচ্ছু যায়-আসেনি, আজও যায়- আসেনা।
- কিন্তু আমার যায়- আসে। আমি সাধারণ ঘরের মেয়ে।আমাকে মানুষের সামনে দাঁড়াতে হয়।
- দাঁড়াও।কে মানা করেছে। তবে ভুলে যেওনা আমি যা বলবো তুমি তা-ই করতে হবে।
এই লোকটার সাথে কথা বলাই বৃথা। আমার কেবিনে আসার সময় শুনলাম
- স্যারের বাসায় নাকি একটা মেয়ে থাকে। আমার পরিচিত একজন নাকি প্রতিদিনই দেখে এক সাথে সন্ধ্যায় যায় আর সকালে একসাথে বেরিয়ে আসে।
- আরে এসব বড়লোকদের ব্যাপার- স্যাপার। টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করবে আর কাকে কোথায় রাখে সে সব আমাদের ভাবনার বাইরে।
- মেয়েটা কেমন চিন্তা করেছেন।স্যারের বাসায় থাকে। স্যার তো বিয়েই করেনি।
- আরে টাকার জন্য এসব মেয়েরা সব করতে পারে।
আর কিছু শোনার সাহস হয়নি আমার। বুঝতে পারছি তারা এখনো জানে না সেই মেয়েটি আমি। এতটা জেনে গেছে আর কয়েকদিনের মধ্যে এটাও জেনে যাবে। আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
চাকরিটা না শেষ পর্যন্ত ছাড়তে হয়। যতক্ষণ বাইরে ব্যস্ত থাকি ভালো থাকি।চাকরি ছেড়ে আকাশের প্রাসাদে বন্দী হয়ে থাকতে চাইনা।
দম আটকে মরে যাবো।
আরও একটা সপ্তাহ ভালোই কেটে যায়। আকাশও এরমধ্যে এমন কিছু করেনি।আমিই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এই বাড়ি আর আকাশের সাথে অফিস।
আরও বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আকাশকে এতো টা স্বাভাবিক আগে দেখিনি। আমার সাথেও কোন মিসবিহেইভ করেনি।
তারপর একদিন রাতে আকাশ বিছানায় হালকা হেলান দিয়ে বসে আছে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির আভা।
আমিও বিছানায় বসে চুল ঠিক করছি, শুবো।তখন মনে হলে আমার ঘাড়ে কিছু একটা আছে। আমার হাত কাঁপতে থাকে। ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ঝাড়তেই আমার সামনে এসে পড়লো। আমি চিৎকার করে আকাশকে জড়িয়ে ধরি,চোখ আর খুলি না। মাকড়সা আমি এতো ভয় পাই।আমি আর চোখ খুলে দেখার সাহস করছিনা।
আকাশও সুযোগ বুঝে জড়িয়ে ধরে বলে - আদর খেতে ইচ্ছে করছে তো মুখফুটে বললেই পারো! এতো নাটক করে আমার বুকে আসার দরকার ছিলো না। একবার বলেই দেখতে।
আকাশের কথার মানে বুঝতে না পারলেও চোখ মেলে বুঝলাম আমি ওকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছি...
আস্তে আস্তে বললাম - নাটক মানে? আমার গায়ে মাকড়সা!
- এটা?
তাকিয়ে দেখি মাকড়সা আকাশের হাতে!
আমি চিৎকার করে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।
- আরে.. ছাড়ো, ছাড়ো। দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।
এটা ফেলে দিয়েছি।
- কি?সত্যি?
তাকিয়ে দেখি নেই। যাক বাবা বেঁচে গেছি।এতোক্ষণে মনে পড়লো আমি এখনো ওকে ধরে রেখেছি।এবার লজ্জা পেয়ে গেছি।আস্তে আস্তে ওকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আকাশ ছাড়ছে না।
- ছাড়ুন।
- তুমিই তো ধরেছিলে আমি কি ধরতে বলেছিলাম? আদর পেতে নাটক করলে।
- ছিঃ কীসব যা-তা বলছেন।।
- যা সত্যি তা-ই। এখন তো আর ছাড়াছাড়ি নেই।
আজ এক অন্য আকাশকে আবিস্কার করলাম। বিয়ের পর যতবার সে কাছে এসেছে প্রতিবার আমি নরকের যন্ত্রণা ভোগ করেছি। কিন্তু আজ তার স্পর্শে অন্যকিছু ছিলো। নিজের অজান্তেই আমি আবেশে বন্দী হয়ে যাচ্ছি।
কি করছি আমি? মনে পড়তেই সরে যেতে চাইলাম।
- এই মেয়ে! এতো হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করলে মাকড়সা লাগিয়ে দিবো।এইযে ওখানে রাখা আছে।
তাকিয়ে দেখি সত্যিই সাইড টেবিলে রাখা!
ভয়ে হাত-পা জমে আসে। এই লোকের বিশ্বাস নেই,সত্যি - সত্যিই দিবে।
আমার মাথা তখন অন্যদিকে যাচ্ছে। আজ আকাশের ছোঁয়ায় আমি যেন ঘোরে ডুবে যাচ্ছি। সত্যিই অন্যরকম ভালোলাগার ঘোরে ডুবে গেলাম।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে নিজেকে আকাশের বুকে আবিস্কার করলাম।উনিও জড়িয়ে রেখেছেন। গতরাতের কথা মনে পড়তেই নিজেই লজ্জা পেলাম। আকাশের হাত সরাতেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসে এলোমেলো নিজেকে গুছাতে ব্যস্ত।আকাশ ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।
হঠাৎ মাকড়সার কথা মনে পড়তেই তাকিয়ে দেখি এখনো সেখানেই আছে।
- মরে গেছে নাকি?
- কি?
- রাতের মাকড়সা টা।নড়াচড়া করছে না। এখনো এক যায়গায়ই আছে!
- বোধহয় মরে গেছে। তোমার চিৎকার শোনার পর এটা হার্ট-অ্যাটাক করে মারা গেছে নিশ্চিত।
আকাশের ঠোঁটের কোনে একটা চাপা হাসি আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে।
উঠে এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে দেখলাম। নাহ, নড়াচড়া নেই। আরও ভালো করে খেয়াল করে দেখি এটা নকল!
তারমানে আকাশ ইচ্ছে করে করেছে এসব!
চোখ পাকিয়ে আকাশকে বললাম - আপনি! আপনি ইচ্ছে করে ভয় দেখিয়েছেন এই রাবারের মাকড়সা দিয়ে।
- আমি মোটেও এসব করিনি। তুমি করেছো।তুমি আদর খেতে চেয়েছো এজন্য সব নিজে সাজিয়েছ,আর এখন আমার দোষ দিচ্ছো।এখন সব বুঝতে পারছি আমি।'
আকাশের কথা শোনে রাগে ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ি।
অফিসে যাবার পথে আকাশকে বেশ ফুরফুরে মনে হলো।আকাশের অনেক কিছুই এখনো আমার অজানা। কত রূপ দেখেছি এই মানুষটার।
- আচ্ছা আপনার বাসায় আপনার নিজের কোনো মানুষজন নেই কেন? কোনোদিন আপনার বাবা-মায়ের কথা শুনিনি। আর একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সারাবাড়িতে উনাদের কোনো ছবি নেই কেন?
- আমার কেউ নেই।
মুখশক্ত করে জবাব দেয় আকাশ। তারপর আর কোনো কথায় বলেনি।তবে তার চেহারার রং পাল্টে গেছে এটা চোখে পড়ার মতো। তাই আমিও আর ঘাটাইনি।হয়তো আমার মা-বাবার মতো উনারও....
শুধু শুধু মনে কষ্ট দিলাম উনার।
অফিসে পৌঁছে আকাশ আমার আগে গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে চলে যায়।
তারপর যতক্ষণ অফিসে ছিলো সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে ছিলো।যে সামনে যাচ্ছে সে-ই তোপের মুখে পড়ছে। লাঞ্চের আগেই বেরিয়ে যায় আকাশ।
অফিস শেষে বের হয়ে দেখি আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে,কিন্তু আকাশ নেই।
বাসায় ফিরেও আকাশকে কোথাও পেলাম না।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৬
বাসায় ফিরেও আকাশকে কোথাও পেলাম না। এদিকে ঘনকালো কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়।একা একা বসে আছি। ভালো লাগছেনা। এ বাড়িতে অনেক মানুষ, সবাই সময় মতো সব কাজ করে। আকাশের রুমের এদিকে তারা একটা নিদিষ্ট সময়ে আসে।তাছাড়া উপরে তারা তেমন একটা আসেনা।
আমি নিজে গিয়ে কখনো কথা বললেও তারা খুব গুটিয়ে থাকে। এটা আমার খুব খারাপ লাগে, তারা আমার উপস্থিতিতে জড়োসড়ো হয়ে যায়। এতো মানুষের ভীড়েও আমি একা।
বাবা-মার কথা মনে পড়ছে খুব।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি, তাও মন খারাপ হচ্ছে। আমি আবার অনেক গান শুনি। মনে হয় গান শুনেই বেঁচে আছি। মন খারাপ হলেই আরও বেশি গান শুনি। রুমে এসে একটা গান প্লে করে আবার বেলকনিতে আসি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির হালকা ঝাপটা চোখেমুখে লাগে। অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। তখন এই একটা গান আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়। মফস্বলে বড় হয়েছি আমি। বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। যখন ছুটিতে আসতেন বাড়িতে, মনে হতো আমাদের বাসায় ঈদ! বাবার আদরের রাজকন্যা আজ... নিয়তি কোথায় কোথায় নিয়ে যায়। মামির সংসারে লাথি-ঝাটা খেয়ে আজ আকাশের হাতের পুতুল!
ভীষণ মনে পড়ছে বাবা-মার কথা।
'কেন তোমরা আমাকে ফেলে চলে গেলে? যাবেই যদি নিয়ে যাওনি কেন সাথে? '
এই গান আমার কলিজ্বায় লাগছে।
"কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসেনা
জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মত কেউ বলেনা
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…
আয়রে আমার সাথে গান গেয়ে যা
নতুন নতুন সুর নে শিখে নে
কিছুই যখন ভাল লাগবেনা তোর
পিয়ানোয় বসে তুই বাজাবিরে
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…
.
সিনেমা যখন চোখে জ্বালা ধরায়
গরম কফির মজা জুড়িয়ে যায়
কবিতার বইগুলো ছূঁড়ে ফেলি
মনে হয় বাবা যদি বলতো আমায়
আয় খুকু আয়…....
দোকানে যখন আসি সাজবো বলে
খোঁপাটা বেঁধে নেই ঠান্ডা হাওয়ায়
আরশিতে যখন এই চোখ পড়ে যায়
মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়
আয় খুকু আয়…
হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে তাকিয়ে দেখি আকাশ এসেছে। উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ লাল।
নিজের অজান্তেই আকাশের মনে কষ্ট দিয়েছি ওর বাবা-মার কথা বলে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি আমার চোখ মুছে নিলাম। এমন আকাশ এসে এমন ভাবে হাতে চেপে ধরলো, খুব ব্যথা পাচ্ছি, কিন্তু মুখে বলতে পারছিনা।
- এই মেয়ে, তুমি কি মনে করো নিজেকে?তুমি আকাশকে বদলে দিবে? ইমোশনাল করে দিবে? নো! নেভার! আকাশ যেমন ছিলো, তেমনই থাকবে।'
ব্যথায় চোখে পানি চলে আসে। আকাশ হাতটা ছেড়ে চলে যায়।
আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি।
মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি আকাশ নেই বিছানায়। ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। কিন্তু অনেক সময় পরেও যখন এলো না, আমি তখন উঠে গেলাম। উঠেই একটা হুঁচোট খেলাম।ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় দেখি আকাশ বিছানা সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে দুই হাঁটুতে হাত রেখে মাথা গুঁজে আছে। আমি বেশ অবাক হলাম। কাছে যেতেই বুঝলাম আকাশ কাঁদছে!
আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে আকাশের জন্য। কেন জানি মনে হচ্ছে আকাশও আমার মতোই অসহায়। আস্তে করে কাঁধে হাত রেখে বিছানার কিনারায় বসলাম। আকাশ কেন কাঁদছে? কি বলে সান্ত্বনা দিবো?
আকাশ আমার দিকে তাকায়নি, শুধু একটু সরে এসে আমার কোলে মাথা গুঁজে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।
- কি হয়েছে আকাশ? আপনি কাঁদছেন কেন?
আকাশ কোনো কথা বলে না। আমি ওর মাথায় হাত রাখি। কি বলবো, বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। একটা সময় আকাশ শান্ত হয়ে যায়। চুপচাপ শুয়ে থাকে।
কিছু সময় পরে আকাশকে বিছানায় নিয়ে এলাম।একেবারে বাধ্য শিশুর মতো সে এসে শুয়ে পড়ে।
বেশ কয়েকটি মাস কেটে যায়। অফিসের লোকদের বাঁকাদৃষ্টিতেও আমি চাকরিটা করছি।
এরমধ্যেই একদিন অফিসে পার্টির আয়োজন করা হলো। নতুন একটা কোম্পানির সাথে চুক্তি উপলক্ষে এই আয়োজন। সবদিক বিবেচনা করে আকাশ সন্ধ্যায় পার্টি রাখে। অফিসে আলাদা হলরুম রয়েছে, সেখানেই এই পার্টি, কনফারেন্স হয়ে থাকে। পার্টিতে সবাই ব্যস্ত। আকাশ ও নতুন যারা গেস্ট তাদের সময় দিচ্ছে। আমি একপাশে সরে চুপচাপ দেখছি।কিছু সময় তুলির সাথে গল্প করলাম। আকাশ তুলিকে ডাকতেই তুলি একটা কাজে চলে যায়।
এমন সময় এই অফিসের একটা লোক এসে উনার সাথে ড্যান্স পার্টনার হতে বললো। আমি খুব ভদ্রভাবেই উনাকে রিজেক্ট করলাম।উনি চলে গেছেন। কিছু সময় পর গেস্টদের মধ্যে একজন এসে অফার করলেন। সেটাও আমি রিজেক্ট করে বললাম - এক্সকিউজ মি! আমি এসবের সাথে কম্ফোর্টেবল নই।ধন্যবাদ।
ডেইজি কোথা থেকে এসে বললো - ঢং দেখে বাঁচি না! যত্তসব ন্যাকামি!
স্যারের সাথে থাকতে তো লজ্জা করে না। ধোয়া তুলসীপাতার ভাব নিয়ে লাভ নেই,স্যারের সাথে যে রাত কাটাও সেসব খবর আমরা জানি।
ডেইজির কথা শুনে আমার কানদিয়ে মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে!
- ডেইজি!
নিজেকে সামলাতে না পেরে চড় দেয়ার জন্য হাত তুলতেই ডেইজি আমার হাত ধরে ফেলে।
- হয়েছো তো স্যারের রক্ষিতা! সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার?
তখন দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বললো- তাই নাকি? আকাশ সাহেবের পছন্দ আছে বলতে হবে। ইউ আর সো সেক্সি! তা আমি একবার একটু পরখ করে দেখতে চাই। আকাশ সাহেব পুরো সপ্তাহে যা দেয়, আমি এতরাতে তার দ্বিগুণ দেবো।প্লিজ আপত্তি করবেন না।
এক মুহূর্ত আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। মুখে হাত চেপে দৌড়ে বের হয়ে আসি। আকাশ কোথায় নামিয়েছে আমাকে! কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটছি আর চোখ মুছি বারবার।এই ছিলো আমার কপালে?
আকাশ এটাই কি তবে চেয়েছিলো? কিছু ভাবতে পারছিনা। ইদানিং মাথা ভীষণ যন্ত্রণা করে,মাথা ঘুরায়।এখনো আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে।
এমন সময় আকাশের গাড়ি আমার সামনে এসে থামে। আকাশ বেরিয়ে আসে,আমার হাত ধরে বলে - চলো আমার সাথে।
- কোথায়?
- অফিসে।
ঝাটকা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দেই।রাগে আমার চোখে আগুন জ্বলছে।
- কেন? আরও ক্লাইন্ট আছে নাকি আপনার? যারা উনাদের সাথে রাত কাটানোর অফার করবে।
আকাশ ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় আমার গালে।
- চুপচাপ আমার সাথে চলো।
- যাবো না আমি। কোথাও যাবো না।
আকাশ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলতে তুলতে বললো - সবাই জানুক তুমি কে।সবার জানা প্রয়োজন।
- কি জানাবেন? আমি আপনার দুই বছরের চুক্তি করা বউ? আপনার ব্যবসায় যেমন চুক্তি করেন,আজ এটার সাথে- চুক্তি শেষ হলে কাল নতুন কোনো কোম্পানির সাথে!
সবাইকে এটাই জানাতে চাইছেন?
- একদম চুপ থাকো তুমি। চুপচাপ বসে থাকবে।
- ভুল কি বলছি? তারাও ভুল কিছু বলেনি।আপনার চুক্তি শেষ হলে আরেক জন আমাকে একমাসের জন্য চুক্তির অফার করতে পারে! একজন তো একরাতের অফার করলো!
- এই মেয়ে, চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবি না।
আকাশ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো।
আমি কেঁদেই যাচ্ছি।
আকাশ আমাকে অফিসে না নিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় আসার সাথে সাথে আমি দৌড়ে রুমে চলে আসি।
মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।আকাশও আমাকে ডাকেনি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো। আকাশ অফিসে যাবার জন্য রেডি।আকাশকে বললাম
- আমি চাকরি টা করবো না।
- কেন? ওদের জন্য চাকরি ছেড়ে দিবে?
- না। আমি নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো - ঠিক আছে। তুমি করতে না চাইলে জোর করবো না। তারপর সে চলে যায়।
লাঞ্চের পরে আকাশ ফিরে এসে বললো - তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, একটু বের হবো।
- কোথায় যাবো?
- এতো প্রশ্ন করো কেন? রেডি হতে বলেছি তাড়াতাড়ি।
শহরের বাইরে এক শান্ত নদীর পাড়ে নিয়ে আসে আমায়।অদ্ভুত সুন্দর, শান্ত,সবুজ এই যায়গা নিমিষেই মন ভালো করে দেয়।
- আমার যখন খুব বেশি মন খারাপ লাগে পার্টি,ক্লাব,বন্ধু- বান্ধবও বোরিং মনে হয়; তখন এই যায়গায় চলে আসি।
- আপনার অনেক পছন্দের যায়গা?
- হুমম।
চুপচাপ বসে আছি দুজন গাছের ছায়ায়। বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে নদীর পানি দেখছি।
আমি ভাবছি তুলির কথা। আকাশ অফিস থেকে বের হবার পরই আকাশের পি.এ. তুলি ফোন করে আমাকে।।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৭
আমি ভাবছি তুলির কথাগুলো। আকাশ অফিস থেকে বের হবার পরই তুলি আমাকে ফোন দিয়ে বলে- মেডাম, আপনি অফিসে আসলেন না?
- তুলি আমি চাকরি টা আর করবো না।
- সেকি! কেন মেডাম?
- আমি আর করতে চাইছি না।
- মেডাম কাল যা হয়েছে তার জন্য সবাই লজ্জিত। আর আপনি যে স্যারের ওয়াইফ সেটা তো কেউ জানতো না।তবে আমি ভেবেছিলাম আপনি স্যারের গার্লফ্রেন্ড! হিহি..
স্যার কালকে যা কান্ড করলেন। আসলেই মেম আপনি অনেক লাকি স্যারের মতো হাজবেন্ড পেয়েছেন।।
- কি করেছেন উনি?
- আসলে কাল যা হয়েছে আমি সবটা দেখেছি, যখন স্যারকে জানাতে গেলাম, তখন আপনি চলে গেছেন। স্যার আসার পর অই লোক স্যারকে বলে - মি. আকাশ আপনার চয়েস আছে বলতেই হবে! আপনার মিসস্ট্রেস তো জোস!
স্যার তখন অই লোকের কলার ধরে বলে - কি বললি? লোকটা ভয় পেয়ে যায়। বলে - আপনার অফিসের তারাই বলেছে - মেয়েটা আপনার রক্ষিতা!
স্যার এলোপাতাড়ি মারতে থাকে লোকটাকে।
অনেক কষ্টে স্যারকে সবাই ফেরায়।
স্যার তখন অনেক চিল্লাচিল্লি করে। বলে - রক্ষিতা শব্দ টা কে দিয়েছে? যে রক্ষা করে সে-ই রক্ষিতা! কিন্তু অদ্ভুত এই সমাজ কো-ওয়াইফকে রক্ষিতা নামে ডাকে!
হা,কাজল আমার রক্ষিতা! কারণ আমাকে রসাতলে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছে।এখানে অনেক মানুষ আছে যারা আমার সুযোগ নিতে চেয়েছে, তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন সবাই - কাজল আমার বিবাহিতা স্ত্রী!
আর যারা এই অফিসে আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, ষড়যন্ত্র করেছেন সবাইকে আমি চিনি,তাই আমি কোনো ব্যবস্থা নেবার আগেই কালকের মধ্যে স্বেচ্ছায় অব্যবহিত দিয়ে চলে যাবেন।
আর তুলি এখনই ফাইল রেডি করো এই চুক্তি বাতিল! যত টাকা লস হবে হোক! এই বাস্টার্ডদের সাথে কোন চুক্তি হবে না ভবিষ্যতেও না।
মেডাম! আমি তো হা করে স্যারের কথা শুনছিলাম। আপনাকে এতো ভালোবাসে! আপনাদের জুটি সেরা মেডাম। আর ডেইজিসহ দুইজন আজ চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।
- থেংকস তুলি।তোমার স্যার এখন কোথায়?
- স্যার তো বেরিয়ে গেছেন একটু আগেই।
তুলির সাথে কথা বলার একটু পরই আকাশ এসে এখানে নিয়ে আসে।
যায়গাটা বেশ ভালো লাগছে আমার।
- কি ভাবছো?
আকাশের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।
- কিছু না। দেখছি, খুব সুন্দর যায়গা।
- কাজল।
- হুম?
- আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখছি, আমার বাবা মা খুব ব্যস্ত। আমাকে সময় দেবার মতো সময় উনাদের ছিলো না। চাকরদের হাতে বড় হয়েছি বললেই চলে। বাবা অফিস, ইনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আর মা! উনার ক্লাব,সমিতি! কত কিছু নিয়ে ব্যস্ত!
সারাদিনে শুধু ব্রেকফাস্ট করার সময় সবাইকে এক সাথে দেখতাম।তখন আমারও তাড়া স্কুলে যাবার। তারপর রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়তাম তখন উনারা বাসায় ফিরতেন।আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। যা চাইতাম, তাই পেতাম। অনেক টিউটর ছিলেন, তারা একজনের পর একজন আসতেন।বাবা-মা এসবের কমতি রাখেনি। তবে একটা বাচ্চার যে বাবা-মার প্রয়োজন সেটা তারা দিতে পারেনি।
তবে একজন মানুষ ছিলো, যাকে আকঁড়ে ধরে বেঁচে ছিলাম - আমার দাদু।
দাদু আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন, যাতে বাবা-মার অভাব বোধ না হয়। দাদু আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। আজ প্রায় পাঁচ বছর - দাদু আমাকে একদম একা রেখে চলে গেছেন।দাদুর চলে যাওয়ায় আমি বেপরোয়া জীবন যাপন শুরু করি।এইসব ব্যবসা শুধু দাদুর নাম রক্ষার জন্য আঁকড়ে আছি।
আরেক জন ছিলেন - গফুর চাচা! ছোট বেলা থেকে দাদু আর উনি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। আমি কিংবা দাদু কখনো উনাকে কাজের লোক মনে করিনি।
আকাশের কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছি না। মৃত্যু এমন একটা বিষয়, যার সান্ত্বনা দেয়া যায় না। যার হারায় সে-ই বুঝে, আমিও বুঝি।
আকাশের বাসায় শুধু ওর দাদুর ছবি কেন সেটা এখন বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর বাবা-মা?
- আপনার বাব-মাও কি?
- আমার কেউ নেই, কেউ ছিলো না।শুধু দাদু ছিলো, সে হারিয়ে গেছে!
আকাশের কথার কিছুই বুঝতে না পারলেও এটা বুঝলাম যে বাবা-মার প্রতি একটা কষ্ট আছে ভেতরে কোথাও। তাই এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
কখন যে দেখতে দেখতে প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।ইদানীং শরীরটা একদম ভালো লাগছেনা।কেমন লাগে সেটাও আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । আকাশ শুনলে হুলুস্থুল কান্ড বাধাবে, তাই ওকে কিছু বলিনি।মাথা ঝিমঝিম করে। অবশ্য মাথাব্যথা প্রায়ই হয়।হয়তো এজন্য মাথা ঘুরায়।
এদিকে আকাশ অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। ওর দাদুর নামে একটা হাসপাতাল তৈরি করছে। অফিস- হাসপাতালের কাজ সব তদারকি করতে গিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। সেই সকালে বের হয়ে রাতে ফিরে। আর আমি সারাদিন বাসায় থাকি। মাঝেমধ্যে মামার কাছে যাই,কখনো সাইফ-সুমনা আসে।এর আগে আকাশ একদিন আমার মামা-মামিকে নিয়ে আসে।আমি এতো খুশি হয়েছিলাম উনাদের দেখে! কারণ আমি ভাবতে পারিনি আকাশ উনাদের নিয়ে আসবেন। মামা-মামিও এখানে এসে খুব খুশি। আকাশ
জোর করেই দুদিন উনাদের এখানে রেখেছে।
আগে যখন অফিসে যেতাম তখন এই বাসার যারা আছে তাদের সাথে মেশার সুযোগটা পাইনি তেমন। এখন হাতে প্রচুর অবসর সময় থাকায় আমি সংসারের সব দেখাশোনা করতে পারছি।যারা এখানে আছে প্রত্যেকেই খুব মিশুক। আগে আমারকে দেখে সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতো।এর কারণ যে আকাশ তা আমি বুঝতে পেরেছি আগেই। আকাশ আগে বাসায় একদম থাকতো না বললেই চলে, কিন্তু হাসপাতালের কাজ শুরু করার আগে আকাশ বাসায় প্রচুর সময় কাটিয়েছে। খুঁটিয়ে দেখেছে বাগানের প্রতিটি গাছ।এতে এ বাড়িতে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে আসে। এখন অনেক ব্যস্ত তাই সে সময় হচ্ছে না। কিন্তু আমি ভালোই সময় কাটাচ্ছি। শোভা নামের একটা মেয়ে আছে, গফুর চাচার মেয়ে।সেও এখানেই কাজ করে, সবার কাজের তদারকি করে।মেয়েটা ভারী মিষ্টি দেখতে আর ভীষণ মিশুক।আমার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে। আজ কাঁচা আমের ভর্তা,কাল তেতুল,কখনো বাগানের ডাসা পেয়ারা নিয়ে আসে আমার জন্য।
কেমন মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি এই সংসারের।
আকাশের প্রতি আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে। কি জানি কেন সারাক্ষণ তার কথায় মনে পড়ে।
আমি কি আকাশের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি?
কি সব চিন্তা করছি আমি? আকাশকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি।না আকাশ আমায় ভালবাসে, না আমি আকাশকে।
দুই বছর পূর্ণ হলেই তো চলে যাবো এ বাড়ি থেকে।
আরও তিন মাস কেটে গেছে।এদিকে হাসপাতালের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আকাশের ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে। ইদানীং আমার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মাথা ঝিমঝিম করে, মাঝে মধ্যে বমি বমি ভাব হয় খুব।
দুদিন বমিও হয়েছে। আজ যখন আকাশ অফিসে চলে যায়,খুব খারাপ লাগছিলো তাই শুয়ে ছিলাম অনেক সময়। তারপর যখন উঠে গেলাম মাথাঘুরে পড়ে যাই। তখন শোভা উপরে এসেছিলো, সে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি আরও অন্যদের ডেকে এনে রুমে নিয়ে মাথায় পানি দেয়।
কিছুটা সুস্থ বোধ করলেও শোভা জোর করেই ডাক্তারের কাছে পাঠায়। আমি একা যেতে পারবো না ভেবে সে নিজেও আমার সাথে আসে।
তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
কিন্তু আমার ভীষণ ভয় করছে। শোভা যা ভাবছে সত্যিই যদি তা হয়! কি করবো আমি?
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৮
আমার একদিকে যেমন ভয় লাগছে,অন্যদিকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছে আবার আতঙ্কিত হয়েও আছি! এ যেন এক মিশ্র অনুভূতি। ডাক্তার অনেক গুলো টেস্ট করালেন। সামান্য এই সমস্যার জন্য এতো টেস্ট করতে হবে কেন বুঝিনা। কিভাবে যে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিবে সেই ধান্ধায় থাকে মনে হয়! এসব মনে মনে ভেবে বিরক্ত হচ্ছি।রিপোর্ট পরদিন দিবে তাই বাসায় চলে আসি। সন্ধ্যায় আকাশ বাসায় ফিরে এসে দেখে আমি বিছানায় শুয়ে আছি। - এই সন্ধ্যায় শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ? - না মাথাটা ধরে আছে। তাই। - রেডি হও, এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাবো। আমি যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম সেটা ওকে জানানো যাবে না। আর এখন নিয়ে গেলে আবার পরীক্ষা করবে আর কি রিপোর্ট আসবে সেটা আকাশ জেনে যাবে, কিন্তু আমি সেটা চাচ্ছি না।আর তাছাড়া সারাদিন শেষে বাসায় এসে আবার আমাকে নিয়ে বের হবে, সেটাও আমার খারাপ লাগবে। তাই বললাম - আরে তেমন কিছু না। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ ঘুমায়নি তাই মাথা ধরে আছে। - ওহ! তাই বলো। জানো, আর মাস দুয়েক এর মধ্যে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমি খুবই এক্সাইটেড। আকাশের চোখেমুখে খুশি, কত প্রাণখুলে মনে হয় হাসছে। পরদিন আমি নিজেই রিপোর্ট আনতে গেলাম। ডাক্তার বললো- আপনার গার্ডিয়ান কেউ আসেনি? - ডক্টর, আমার আসার মতো কেউ নেই। তাই যা বলার আমাকেই বলুন। ডাক্তার রিপোর্ট দিলেন আমার হাতে। রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছি। আমি বসা থেকে উঠতে পারছিনা মনে হচ্ছে আমার। তারপর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম।আমার পা ভেঙে আসছে। এখন কি করবো আমি? এখন কাউকে কিছু বলা যাবে না। তারপর বাসায় ফিরে আসি।শোভা দৌড়ে আসে আমায় দেখে। - ভাবি,ডাক্তার কি বললো? আমি মৃদু হেসে বললাম - তেমন কিছুই না অতিরিক্ত টেনশনে নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছি। শোভার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম ও আশা ভঙ্গে ব্যথিত হয়েছে। তারপরও তাকে কিছু বলতে পারলাম না। প্রায় দেড় মাস পরে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। আকাশ আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। হাসপাতাল তৈরি হয়ে গেছে, তবে চালু করতে আরোও চার-পাঁচ মাস লাগবে নতুন কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স নিয়োগের প্রসেস শেষ হতে। আকাশের ব্যস্ততা এখন কমেছে। আজকাল আকাশ অনেক খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু আমার ভেতরে কি চলছে আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না। আর মাত্র কয়েকটা দিন। দুই বছর পূর্ণ হলেই আমিও চলে যাবো আকাশের জীবন থেকে। কিন্তু আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে আমার ভেতর টা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষজন,এ বাড়ির ছাদ,বাগান সব কিছুর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। এরমধ্যেই আমার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারছিনা। আকাশের ব্যস্ততা এখন অনেক টা কম হওয়ায় বাসায় থাকতে পারছে অনেক সময়। আকাশ যখন দেখলো একদিন বমি করতে,তখন জিজ্ঞেস করলো- - কি হয়েছে তোমার? - তেমন কিছু না। হঠাৎ এমন হলো মনে হয় এসিডিটির জন্য। আকাশ কিছু না বললেও, ওকে চিন্তিত মনে হলো। এরপরে একদিন আকাশ আমাকে নিয়ে বের হতে চাইছে, কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছে যে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ক্লান্তিতে হাত-পা ভেঙে আসে আমার।নিজের ভেতরে নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু শরীর যেন মানছে না। আজ সকালেও কেমন শরীর খারাপ লাগছে। বমি বমি ভাব, খুব কষ্টে আটকে রাখতে চাইলাম, কারণ আকাশ বাসায় ছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না! হঠাৎ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কোনোরকমে বিছানায় এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি।মাথা ভার হয়ে আছে। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই বিছানার কিনারায়। আকাশ বেলকনিতে ছিল।সে দৌড়ে আসে। - কাজল কি হয়েছে তোমার?!! কাজল? আমি জ্ঞান হারাইনি।মাথা চক্কর দিচ্ছিলো। - কিছু হয়নি।মাথা... - আর কোনো কথা শুনবো না। এখনই যাবে আমার সাথে। আকাশকে শত অনুরোধ করেও আটকাতে পারিনি। জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এদিকে টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ! যদি রিপোর্ট দেখে? কি হবে তখন? যাবার সময় আকাশ বললো - কাজল। - হুম? - একটা কথা বলতে চাইছিলাম। - বলুন। মৃদু হেসে আকাশ বললো - আমার মনে হচ্ছে তোমার সমস্যা অন্যকিছু। আমাকে আবার নতুন করে বাঁধার কিছু করোনি তো?!! আকাশের কথার মানে আমি বুঝতে পারছি। তাই কিছু বললাম না। আমি অস্বস্তি বোধ করছি, আকাশ সেটা বুঝতে পেরে সেও আর কিছু বললো না। ভাগ্য ভালো আগে যে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম সেই হাসপাতালে আসলেও ;সেই ডাক্তার না আজ অন্য ডাক্তার ছিলেন। আবারও টেস্ট করতে দিলো। করলাম। আকাশ বসে আছে রিপোর্ট নিয়েই যাবে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। অনেক বুঝিয়ে আকাশকে রাজি করালাম, আগামীকাল আকাশ রিপোর্ট নিয়ে যাবে। অবশেষে আকাশ রাজি হলে বাসায় ফিরে আসি। এদিকে আমার ভেতরে ঝড় বইছে। আর মাত্র একটা দিন।আকাশের সাথে সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমি চাইছিনা আকাশ কিছু জানুক। পরদিন। আকাশ অফিসে চলে যায়, সেই সুযোগে আমি নিজেই রিপোর্ট নিয়ে আসি,তবে ডাক্তারকে আর রিপোর্ট দেখাইনি।কারণ ডাক্তার আকাশের খুব পরিচিত। আমি তো জানি রিপোর্ট কি এসেছে। বিকেলবেলা আকাশ বাসায় ফিরে।আমাকে বললো রেডি হতে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রিপোর্ট আনতে যাবে। এখন কি করবো? হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আকাশও বের হবার জন্য রেডি হচ্ছে, ঠিক তখনই একটা ফোন আসে। রাগে আকাশের চোখেমুখ লাল হয়ে গেছে। একটা বিষয় খেয়াল করলাম,একটা ফোন আসে মাঝেমধ্যে আর আকাশ এইভাবে রেগে যায়। কে ফোন করে? আর আকাশই বা এভাবে রেগে যায় কেন? হাজার টা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। আমি রুমের চলে আসি। কিন্তু হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দেখি আকাশ চেয়ারে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। রাগে উচ্চস্বরেই কথা বলছে - কি চাও আমার কাছে আমি সব বুঝি। একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি আমার সাথে আর ভুলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। দাদু আমাকে যা যা দিয়ে গেছেন তার কানাকড়িও তোমাদের দিবো না। সব ভুলে যাও কিভাবে তোমরা? ওই মহিলা দাদুকে কম কষ্ট দেয়নি। কি বললে? মা? হা... মা! আরে অই মহিলা আমাকে ঠিক মতো খেতেও দিতো না! কোথায় ছিলে তুমি তখন? আমাকে আর কখনো ফোন দিবে না। তোমাদের উদ্দেশ্য আমার জানি। যোগাযোগ করতে চাইলে খুব খারাপ হবে। ' মোবাইলটা ছুড়ে ফেলে আকাশ। কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রাখি। - আমাকে মা দেখায়! বাবার দায়িত্ব দেখায়! আরে স্বার্থপরগুলো আমার দাদুর সম্পত্তির জন্য ফোন করে আমাকে। মা!..... সারাক্ষণ এই বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকতো। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন উনাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। একটা বার আমার কথা ভাবলো না।আমার মা আমাকে ফেলে অন্য একটা লোককে বিয়ে করে দেশ ছেড়ে যায়।আর বাবা! উনার প্রেমিকাকে বিয়ে করেন! আমি স্কুলে যেতে পারতাম না, বাসা থেকে বের হতাম না।বন্ধু-বান্ধবেরা হাসাহাসি করতো।পিছনে তো বলতোই সামনেও অনেক কিছু বলতো।স্কুল ছেড়ে দিতে চাইলাম, শুধু দাদুর জন্য পারলাম না। বাবা অই মহিলাকে নিয়ে আসে। তখন দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েন।ঐ মহিলা দাদুকে ঠিকমতো ঔষধও এনে দেয়নি,খাবার দেয়নি।বাবা এসবের কোনো খোঁজ রাখেনি। গফুর চাচা না থাকলে দাদু তখন মরেই যেতেন।খাবার খেতে একটু দেরি হলেই আমার সামনে থেকে খাবার নিয়ে যেত। আমি সবার শেষে স্কুলে যেতাম, সবার পিছনে বসতাম, ছুটি হলে সবার আগে স্কুল ছাড়তাম, শুধু লজ্জায়! দাদু যখন সুস্থ হয়ে উঠেন উইল করে সব কিছু আমার নামে করে দেন আর বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। উনাদের অনেক আছে, অনেক থাকার পরেও দাদু আমাকে যা দিয়েছেন সেটা নেবার জন্য এখন বাবার দায়িত্ব ফলাতে আসে। সব স্বার্থপর! সব। কাউকে চাই না আমার। আমি রাতে একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। - আকাশ শান্ত হোন আপনি। - তুমি এখানে কি করছো? চলে যাও।তুমিও চলে যাও আমার সামনে থেকে। কাউকে চাই না আমার। কাউকে না। কেউ নেই আমার। চলে যাও। আকাশ নিজেই বের হয়ে চলে যায়।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ০৯
আমি রাস্তায় হাঁটছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি আকাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। আকাশ অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে।এখনো ঘুমাচ্ছে আর আমি রাস্তায়। আকাশের যে দুই বছরের চুক্তি ছিলো সেটা শেষ হয়েছে গতকাল। আজ আমি দায়বদ্ধ নই।আকাশ মানুষটা একদম অন্যরকম। অনেক কষ্ট পুষে রেখেছে মনে। আমার প্রতি যতটা অনুভূতি তার কিছুটা আমি আঁচ করতে পেরেছি। আমি চলে যাচ্ছি, আকাশ আরও একা হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কি করার আছে? কিচ্ছু করার নেই। আমি নিজেই নিয়তির হাতের পুতুল। সাইফকে ফোন দিয়েছি।
- সাইফ, তুই একটু আসতে পারবি এখন?
- কোথায় আপু?
- আমি বের হয়েছি।রাস্তায় আছি।তুই আয়।
- কেন আপু? কি হয়েছে?
- কিছু হয়নি।তুই চলে আয় তাড়াতাড়ি।
- আচ্ছা আমি আসছি।কোথায় আসবো বলো।
আমি সাইফকে লোকেশন বললাম। একা যেতে ভরসা পাচ্ছি না। সাইফ আসতে এতো দেরি করছে কেন? আমি একা গাড়িতে উঠবো না।হাত- পা অসার হয়ে আসছে।
এদিকে আকাশ ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু আমাকে কোথাও খুঁজে পায়না। শেষ পর্যন্ত দারোয়ান জানায় আমি খুব ভোরে বের হয়েছি।কোথায় যাবো এতো সকালে আকাশ ভেবে পাচ্ছে না।
রুমে আবার যখন আসলো তখন ছোট চিরকুট চোখে পড়লো।
আকাশ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি অনেক কিছু করেছেন আমার পরিবারের জন্য। গতকাল আপনার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। আমিও কথা রেখেছি। দুই বছর আপনার প্রতিটি কথা মেনে চলেছি। চলে যাচ্ছি আমি, কিন্তু মনে হয় আপনার বাড়ির মায়ায় জড়িয়ে গেছি। কিন্তু যেতে তো হবেই।ভালো থাকবেন।
- কাজল
আকাশের চোখে পানি। এভাবে চলে যাবো ভাবেনি আকাশ। এখন আকাশ ভাবছে নিশ্চয়ই মামার বাসায় ই যাবো আমি।
অনেক ক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর মনে পড়লো রিপোর্ট আনা হয়নি!সাথে সাথেই সেখানে চলে যায়।
- গতকাল রিপোর্ট নেবার কথা ছিল।
- স্যার আপনার ওয়াইফ কাল সকালে রিপোর্ট নিয়ে গেছেন।
- নিয়ে গেছে?
এমন সময় সেই ডাক্তারও যাচ্ছিলেন এদিক দিয়ে।
- আরে আকাশ সাহেব! আপনার ওয়াইফের রিপোর্ট গুলো দেখালেন না?
তখন হাসপাতালের লোকটা বললো - স্যার উনার ওয়াইফ কাল রিপোর্ট নিয়ে গেছেন। কিন্তু উনি এখন রিপোর্ট নিতে আসছেন।
ডাক্তারকে খুব চিন্তিত মনে হলো।
- আপনার ওয়াইফ কোথায়?
আকাশ একটু ইতস্ততভাবে বললো - ওর বাড়িতে চলে গেছে। আমাকে কিছু জানায়নি।একটু ফ্যামিলি প্রব্লেম।
ডাক্তার বুঝতে পারলেন।।বললেন - আসুন আমার সাথে।
তারপর প্যাথলজিতে গিয়ে খোঁজ করলেন।
- গত পরশু একজন পেসেন্ট ছিলেন কাজল নাম। একটু সার্চ করে দেখবেন?
- স্যার ফোন নাম্বার টা বলুন।
আকাশের ফোন নাম্বার দেবার আগেই আমার নিজের নাম্বার দিয়েছিলাম।
তাই আকাশ আমার নাম্বার টা দিলো।
- জি স্যার। উনি দুই মাস আগেও এই টেস্ট গুলো করিয়েছিলেন ডা.আলতাফ নবী প্রেসক্রাইভডে।
- ডা. আলতাফ নবী! একটা কপি দিন প্লিজ! ইটস আর্জেন্ট!
কপি দিলেন তারা। হাসপাতালের সব রেকর্ড করে রাখা হয়।সব রোগীর রিপোর্ট একবছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়।পরের বছর নতুন করে আবার করা হয়।
- ধন্যবাদ।
ডাক্তারের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেছে।
- আকাশ সাহেব একটু কষ্ট করে আসুন আমার সাথে। আপনার সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচয় আমার। তাই ব্যক্তিগত পরিচয় থেকেই আপনার জন্য খোঁজ নিচ্ছি।আসুন ডা.আলতাফ নবীর সাথে দেখা করতে হবে।
- ডা. আলতাফ নবীকে কাজল কেন দেখালো? উনি কিসের ডাক্তার?
- উনি একজন নিউরোলজিস্ট।
- নিউরোলজিস্ট? কিন্তু ডাক্তার...
- প্লিজ আসুন আমার সাথে।
আকাশ ডাক্তারের সাথে ডা.আলতাফ নবীর চেম্বারে যায়।
- স্যার এই রিপোর্ট গুলো দেখেন। কাজল নামের একটা মেয়ের। দুই মাস আগে আপনি এই টেস্ট গুলো করিয়েছিলেন।
ডা.আলতাফ নবী রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে বললেন - হ্যাঁ! আমি করিয়েছিলাম। আমার মনে আছে মেয়েটার কথা। কেন জানেন? মেয়েটা বলেছিলো ওর কেউ নেই, তাই রিপোর্ট গুলো ওর হাতেই দিতে হলো। মেয়েটা রিপোর্ট হাতে অনেক সময় এখানে বসে ছিলো। তারপর সেই যে গেছে আর আসেনি। আমার প্রায় ই মনে হয় মেয়েটার কথা। খুব খারাপ লাগে।
আকাশ কিছুই বুঝতে পারছে না। কি বলছে এসব ডাক্তার!
- ডক্টর, কি হয়েছে বলুন আমাকে? রিপোর্ট কি এসেছে?.
- আপনি কে? মেয়েটার পরিচিত কেউ?
- স্যার, উনি আকাশ চৌধুরী। মেয়েটার হাজবেন্ড।
- হাজবেন্ড! কিন্তু মেয়েটা যে বললো..... আই সি!
- ডক্টর প্লিজ বলুন কি হয়েছে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। প্লিজ বলুন।
ডাক্তার সাহেব একটু সময় চুপ থেকে বললেন - দেখুন আকাশ সাহেব, আমরা ডাক্তার।এধরনের কিছু বলতে আমাদেরও খারাপ লাগে কিন্তু কি করবো বলুন.... আপনার নিজেকে শক্ত রাখতে হবে...
- প্লিজ ডক্টর বলুন কি হয়েছে?
- আপনার ওয়াইফের যে লক্ষণগুলো ছিলো মাথাধরে থাকতো,কখনো খুব ব্যথা করতো,মাথা ঘুরতো,বমি বমি ভাব, হাত-পা অসার হয়ে আসতো এসব দেখে উনি মনে করেছিলেন প্রেগন্যান্সি! তাই অন্য একজন ডাক্তার দেখান।অই ডাক্তার সব শুনে সাথে সাথেই আমার কাছে রেফার করেন। আমি সব টেস্ট করিয়েছি।
এইসব লক্ষণ তারপর চোখে ঝাপসা দেখা সব কিছু আসলে প্রেগন্যান্সির জন্য নয়।
ডাক্তার আরো একটু সময় নিয়ে বললেন - আপনার ওয়াইফের ব্রেইন টিউমার! দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা গুলো হয়ে আসছে, কিন্তু উনি পাত্তা দেননি।'
আকাশের পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে গেছে। ডাক্তারের চেম্বারেই কান্না শুরু করে।
- প্লিজ নিজেকে শক্ত রাখুন। আপনি ভেঙে পড়লে আপনার স্ত্রীকে কে সান্ত্বনা দিবে?
- আকাশ সাহেব আপনি যখন উনাকে নিয়ে এসেছিলেন তখন আমারও এমন সন্দেহ হয়েছিলো। তাই এতোগুলো টেস্ট করিয়েছি। আর তাই স্যারের কাছে নিয়ে এলাম।
আকাশ কান্নাভেজা কন্ঠে বললো - স্যার আমি তাকে কি সান্ত্বনা দিবো! সে গত দুইমাস এই খবর গোপন রেখেছে কাউকে বুঝাতেও দেয়নি!
আকাশ ব্রেইন ও স্পাইনাল সার্জন ডা. আলতাফ নবীর সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসে।
সবাই কেন তাকে ছেড়ে চলে যায়? আকাশের হাত-পা জমে আসছে।কিছু ভাবতে পারছে না আর।
এমন সময় সাইফের ফোন আসে।
- আকাশ ভাই।
- 'সাইফ,বলো।' ভেজা গলায় বললো আকাশ।
- আপুর অবস্থা খুব খারাপ।
- কি হয়েছে কাজলের? কাজল এখন কোথায়?
- আপু আমাকে ফোন করে ওকে নিয়ে যেতে বলে, ও রাস্তায় ছিলো। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বমি হয়েছে কয়েকবার,তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে আসছি।আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।
- কোন হাসপাতাল?
সাইফ হাসপাতালের নাম বলে ফোন রেখে দেয়।
এক মুহূর্ত দেরি না করে হাসপাতালে ছুটে আসে আকাশ। এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে ইমারজেন্সি ট্রান্সফার করায়।
আমার জ্ঞান ফিরেছে। হাসপাতালে আছি বুঝতে দেরি হয়নি। একটু পর সাইফ আসলো। ওর চোখ দুটো দিয়ে পানি ঝরছে। বারবার চোখের পানি মুছে।
- কিরে? কাঁদছিস কেন? আমি এখন ভালো আছি। কান্না করার কি হলো?
- আপু, তুমি এমন কেন? সারাজীবন অন্যের কথা ভেবেই গেলে।
- কি হয়েছে তোর?
- কিছু হয়নি আমার।
সাইফ বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন? কেন প্রিয়জনদের ছেড়ে এভাবে চলে যেতে হয়।
আমার শরীর যখন খারাপ ছিলো ভেবেছিলাম আমি কনসিভ করেছি৷ কিন্তু যখন রিপোর্ট হাতে পাই... আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। ডাক্তারের চেম্বারে অনেক সময় ধরে বসে ছিলাম। আমার বুঝি এটা বাকি ছিলো? আমি জানি আকাশ আমাকে কতটা ভালবাসে।আমাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। শুধু শুধু ওকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।এভাবে চলে এসেছি। আসলে কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমার কাছে কোনো যুক্তি কাজ করছে না।
রিপোর্টের কথা কাকে বলতাম? মামার বাসায় বলে উনাদের কষ্ট দিতে চাইনি।আর আকাশ? এতো কষ্ট পুষে আছে, কি করে নিজের কথা বলে ওর কষ্ট বাড়িয়ে দেই? আমি ভাবতাম আমার কষ্ট আকাশ বুঝে না।কিন্তু তার মনে এই পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে কে জানতো?
তাই চাইনি রিপোর্ট ওর হাতে পড়ুক।কিন্তু এখন যদি এখানে টেস্ট করায় তবে সবাই জেনে যাবে।
এমন সময় আকাশ কেবিনে ঢুকে। ওকে দেখে আমি অবাক হয়নি।নিশ্চয়ই সাইফ খবর দিয়েছে। আকাশের লাল চোখ দুটো ফুলে গেছে।
আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে বসলো। আকাশের অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট লাগছে আমার। ওর দিকে তাকাতে পারছি না। আকাশ আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
- এভাবে ফাঁকি দিতে চেয়েছিলে? কেন কাজল?
একটা বার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি তোমার?
আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আকাশও অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে।
তারপর চোখ মুছে বললো - কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি ডাক্তারে সাথে কথা বলেছি। তুমি একদম চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার এতো কষ্ট হচ্ছে যে মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না।
একজন নার্স এসে একটা ইনজেকশন দিয়ে যায়।
আকাশ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। আমার চোখে ঘুম নেমে আসে।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ১০
মামা-মামী, সুমনা, সাইফ সবাই এসেছে হাসপাতালে। মামা তো কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গেছেন।শুধু বলছেন
- আল্লাহ, তুমি আমাকে নিয়ে যাও।আমার মেয়েটারে রক্ষা করো।
মামী আমাকে সবসময় বকাঝকা করতেন। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি এই বকাঝকার মাঝেও একটা অন্যরকম ভালোবাসা আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না- মা গো,তোকে কত কষ্ট দিছি।আর তুই কি না করেছিস আমাদের জন্য। তোর কিচ্ছু হবে না দেখিস, আমি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবো। তুই ভালো হয়ে যাবি রে মা।
মামা-মামীকে কাঁদতে দেখে আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
সুমনা বলছে -আপু তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেনা সুমনা।
- আচ্ছা, তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করলে আমার ভালো লাগবে বলো?একদম কাঁদবে না।ইনশাআল্লাহ আমি সুস্থ হয়ে যাবো।
কয়েকজন ডাক্তারের সাথে আকাশ আসলো। এতো লোক কেবিনে এলাউ করা হয় না।তবুও মামা-মামীদের আমার অনুরোধে এলাউ করেছে। কিন্তু আর বেশি সময় থাকতে দিলেন না। সবাই বিদায় নিয়ে বাইরে চলে যায়।
আকাশের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
ডাক্তার চলে গেছে। আকাশ আমার কাছে বসে আছে। কোনো কথা বলছে না।
- আকাশ।
- হুমম?
- খুব টেনশন হচ্ছে? আমি সুস্থ হয়ে যাবো। চিন্তা করবেন না।
আকাশ আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো।কিন্তু আমি ঝাপসা চোখেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম চোখ দুটো জলে ভরে আছে। আকাশ আমার হাত ধরে বসে আছে।
সারাক্ষণ আকাশ আমার কাছে কাছে থাকছে।রাতে আকাশ,সুমনা থাকে এখানে।সাইফ সকালে আসে,সেই রাত পর্যন্ত থাকে। দুদিন হয়ে গেছে। এরমধ্যে শোভা এসেছিল দুবার। মেয়েটা কান্নার জন্য কোনো কথা বলতে পারেনি। আকাশ-সাইফ সব দৌড়াদৌড়ি করছে- এই ঔষধ - এটা সেটা আনতে। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন টেস্ট করাচ্ছে।
আকাশ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেল।
- আকাশ সাহেব, সব রিপোর্ট আমরা হাতে পেয়ে বোর্ড মিটিং করেছি।আপনি উনাকে দেশের বাইরে নিতে চাচ্ছেন ঠিক আছে। কিন্তু আমরা এলাউ করছিনা রোগীর অবস্থা দেখে। উনাকে নিয়ে যাওয়াও এখন রিস্কি।
- ডক্টর, আপনারা যেভাবেই হোক ওকে সুস্থ করে তুলুন। যা লাগে তাই ব্যবস্থা করুন। আপনারা বললে এক্ষুনি দেশের বাইরে নিয়ে যেতে আমি প্রস্তুত।প্লিজ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন।
- আপনি শান্ত হোন,মি. আকাশ। আপনাকে রোগীর অবস্থা বুঝতে হবে।
শুনুন, আমরা বোর্ড মিটিং শেষ করে আপনাকে ডেকেছি। আপনি মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
ব্রেইন টিউমার দুই ধরনের হয়।এক ধরনের টিউমার এমন যায়গায় হয় যে সহজে অপারেশন করা গেলেও পরবর্তীতে রেডিওথেরাপি দিতে হয়।কারণ জীবাণু পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। এখানে টিউমার আবারও হতে পারে। এটা ক্যান্সার পর্যন্ত হয়।আরেক ধরনের টিউমার অপারেশন করলে আবার হবার সম্ভাবনা না থাকলেও এটা এমন যায়গা হয় যে অপারেশন করা অনেক রিস্কি। তার উপর অপারেশন পরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থেকে যায়।
আপনার স্ত্রীর যে টিউমার সেটা অপারেশন করলে ভালো হতে পারে,তবে এই অপারেশন করা খুবই কঠিন হলেও আমাদের দেশেই এখন এর উন্নত চিকিৎসা আছে। কিন্তু বললাম না, দেশেই হোক আর বিদেশেই এই রিস্ক নিয়েই অপারেশন করতে হবে। অপারেশন ভালো ভাবে শেষ হলে, যদি রক্তক্ষরণ না হয় তবে উনি সুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
আপনি উনার স্বামী।রিস্ক যদি নিতে চান আমরা অপারেশন করতে প্রস্তুতি। আর আমাদের সাথে একজন বিদেশী স্পেশালিষ্ট আছেন। উনি একটা সেমিনার উপল্লক্ষে এসেছেন। আপনার ওয়াইফ খুব লাকি, কারণ অনেক আগে থেকে চেষ্টা করেও উনার শিডিউল মিলে না৷
এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন। নিয়ে আমাদের জানান। তবে দ্রুত জানাবেন। অপারেশন করতে হলে রোগীকে আগে থেকেই তৈরি করতে হবে।
আকাশ কিছুসময় দু'হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে। ডাক্তার তারাও আকাশের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কারণ তারাও রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ।
- আকাশ সাহেব, ভেঙে পড়বেন না।এটা লাইফ রিস্ক। দুটো পথ আছে আপনার সামনে।হয় রোগী এভাবে কষ্ট পেয়ে মারা যাবে, না হয় অপারেশন। আর অপারেশন টা একমাত্র আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ চান তো উনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
আকাশ নিজেকে স্থির করে নিয়েছে।
- অপারেশন কখন করবেন?
- আগামীকাল আমাদের ও.টি আছে। আমরা চাইছি প্রথম অপারেশন আপনার স্ত্রীর টা করতে। সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না আমরা। রোগীর অবস্থা নিজেই তো বুঝতে পারছেন।
- ঠিক আছে ডক্টর। আপনারা অপারেশনের ব্যবস্থা করেন।
আকাশ টলতে টলতে বের হয়ে আসে।
আমি কখন ঘুমাচ্ছি কখন জেগে উঠছি বুঝতে পারিনা। মাথা অসহ্য যন্ত্রনা করে।হাসপাতালের চার দেয়ালের বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।
আমি যখন থাকবো না তখন তো আর কিছুই দেখতে পাবো না। আমি আকাশ দেখতে পাবো না। আকাশের বাড়িতে পাশাপাশি দুটো শিউলি ফুলের গাছ আছে। যখন গাছে ফুল ফুটতো আমি প্রতিদিন সকালে গাছের নিচে যেতাম। সবুজ ঘাসে যখন শিউলি ফুলগুলো ছড়িয়ে থাকতো, আমার প্রাণ ভরে যেত।আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতাম। আর কখনো আমি সেই শিউলি তলায় যেতে পারবো না।
কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে। ছাদে খোলা বাতাসের দাঁড়িয়ে মেঘ দেখতে পারবো না।
এই পৃথিবীর নিয়ম এতো নিষ্ঠুর কেন?
আকাশ কি করবে যখন আমি থাকবো না? ওর কি খুব বেশি কষ্ট হবে? আমি জানি আকাশ কান্না করবে আমার জন্য। মামার আদর,মামির বকুনিঝকুনি আর শুনতে পাবো না। সাইফ- সুমনা মামিকে লুকিয়ে এটা সেটা আবদার করবে না।
আমার পছন্দের বইগুলোতে ধুলো পড়ে যাবে।সুমনার বিয়ে হয়ে যাবে। কে মুছে রাখবে সেই ধুলো?
আর ভাবতে পারছিনা। মাথা ফেটে যাচ্ছে! উফফ! এতো অস্থির লাগছে কেন আমার?
তখনই একজন নার্স এসে আবারও একটা ইনজেকশন দিয়ে দেয়।
আমার চোখে আস্তে আস্তে ঘুম নেমে আসে।
যখন ঘুম ভাঙলো দেখি আকাশ আমার হাত ধরে বসে আছে।
- আকাশ?
- বলো কাজল।
- আপনি সারাক্ষণ এখানে পড়ে আছেন।ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া কিছুই করছেন না।
- আমি সব করছি।তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না।
আকাশ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আমি মৃদু হেসে বললাম - আমি জানি আপনি নাওয়া-খাওয়া ফেলে এখানে পড়ে আছেন।
আচ্ছা, ডাক্তার কি বলেছে? আর কতদিন সময় আছে আমার?
এক মাস না এক সপ্তাহ? নাকি আরও কম?
- চুপ,কিসব বলছো তুমি? একদম এসব বাজে কথা বলবা না।
- আকাশ, আপনি ওই গান টা শুনেছেন?
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে.....
গানটা বোধ আমার মতো যাদের সময় ফুরিয়ে যায় তাদের জন্য লিখা হয়েছে।
দেখুন আমার সব লেনা-দেনা চুকিয়ে যাচ্ছি।
আকাশ আমার গালে হাত রেখে বললো - কোথাও যাচ্ছো না তুমি। সব লেনা-দেনা বাকি আছে। সব বাকি আছে।
আকাশ কাঁদছে। শব্দ যাতে না হয় অনেক কষ্টে চেপে রাখছে কান্না, কিন্তু চোখ ভেসে যাচ্ছে।
আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।।
আকাশ কাঁদছে। কাঁদুক।
কান্না চেপে রাখতে নেই।ভেতর টা চৌচির হয়ে যাবে। আকাশ বাইরে বেরিয়ে পাগলের মতো কাঁদছে!
আমি চোখ বন্ধ করে বুঝতে চেষ্টা করছি। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। আমি সহ্য করার চেষ্টা করছি।
অনেক টা সময় কেটে যায়। আমার চোখে ভাসছে সেই সে নদীর পাড়,যেখানে আমি রোজ বিকালে বসে থাকতাম। যে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দিতাম। আকাশের হাতের স্পর্শ পেলাম। কিন্তু চোখ খুললাম না।আমার কষ্ট হয় চোখ খুলে রাখতে।
- জানেন আমাদের বাড়ির পাশেই একটা বড় নদী ছিলো। খুব ইচ্ছে করতো প্রতিদিন একটা বার সাঁতার কেটে নদী পাড় হয়ে ওপাড়ে যাই,কিন্তু আমি যে সাঁতার জানি না। বাবার কড়া নিষেধ ছিলো যাতে পানিতে না নামি।
আর আমি সাঁতার জানি না, তাই পানিতে নামতেও ভয় লাগতো। প্রতিদিন নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে বসে দেখতাম। '
আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে, তবুও ইচ্ছে করছে আকাশের সাথে কথা বলতে।
হয়তো আর কখনো সুযোগ পাবো না। কিন্তু যা বলতে চাইছি সে কথাটাই বলা হচ্ছে না।
সুমনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি শুনতে পাচ্ছি।
কিন্তু কিছু বলিনি ওকে।কাঁদুক।
আকাশ আমার হাত টা ধরে বসে আছে। পাগল লোক একটা। যতক্ষণ আমার কাছে থাকে আমার হাত ধরে বসে থাকে, যেন হাতটা ছাড়লেই আমি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো।
আসলেই তলিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।।
দিন ফুরিয়ে আসছে আমার।
আকাশ বুঝতে পারছে আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।কথা জড়িয়ে আসছে মুখে।
- তুমি কথা বলো না। চুপ করে শুয়ে থাকো।আমি তোমার পাশে বসে আছি। তুমি ঘুমাতে চেষ্টা করো।
আমি চেষ্টা করছি ঘুমাতে, কিন্তু ভীষণ যন্ত্রণা করছে মাথায়। এদিকে ঔষধ খাওয়ানোর সময় হয়েছে। নার্স এসে ঔষধ দিলো। আকাশ আমাকে ঔষধ খায়িয়ে দেয়।
আর কথা বলতে পারছিনা, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মুখে।। তাই চুপ করে আছি।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভেঙে যায়, দেখি আজকেও মামা-মামী
এসেছেন। দুজনেই আমার পাশে বসে আছেন। মামা সামনে হুইলচেয়ারে আর মামি আমার হাত ধরে আমার সিটেই বসে আছেন আর বারবার চোখ মুছেন।।
আজ বেশি কথা বলেননি আমার সাথে। যাবার সময় আমার কপালে মামি একটা চুমু দিয়ে যান।আমার চোখে পানি চলে আসে। মামিকে এই প্রথম এভাবে জড়িয়ে ধরলাম। মামিও ধরে রাখলেন উনার বুকের সাথে মিশিয়ে। মনে হচ্ছে কত বছর পরে মায়ের স্পর্শ পেলাম।
মামা-মামী চলে গেছেন।
আকাশ এখানেই ছিলো।
কাছে এসে বসে হাত ধরলো। সে যেন একটা মুহূর্তের জন্য আমার হাত ছাড়াতে চাইছে না।
- কাজল?
- হুম?
কিছু সময় চুপ করে থেকে আকাশ বললো - কাল সকালে তোমার অপারেশন।
আমার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়।
- আরও দু'একটা কি সময় পেতাম না আকাশ? অপারেশন করে কি হবে? করলে তো সেই সময় টুকুও পাবো না।
- অপারেশন করলে তুমি ভালো হয়ে যাবে।
আকাশের কথা শুনে মৃদু হেসে বললাম - আর যদি.....
বাক্য টা সম্পূর্ণ করলাম না।
সব কিছু তো পূর্নতা পায় না। অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই বাক্যটাও অসম্পূর্ণ থাকুক।
আহা জীবন! এ যেন কচুপাতায় টলমল করা পানি। একটু এদিক ওদিক হলেই ঝরে পড়বে!
আকাশ আজ অনেক বেশিই চুপচাপ। হয়তো ভয় পাচ্ছে, পাছে ওর মুখের কথায় ওর ভয়, আশঙ্কা আমার কাছে প্রকাশ হয়ে যায়! নয়তো কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরেই কিছু ঔষধ পাল্টে দিয়েছে।অপারেশন এর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে আগে থেকেই।
আমার এখন যেন কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। জানি অপারেশন টেবিলেই হয়তো আমি মারা যাবো। কিন্তু এখন কেন জানি অনুভূতি গুলো কেমন অসার হয়ে গেছে।
আকাশ সুমনাকে বললো - সুমনা, তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।সাইফ সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে আসবে।
আকাশের গাড়িতেই সুমনাকে বাসায় পাঠালো।
এখন শুধু আকাশ আমার কাছে।। আমি জানি আকাশ সুমনাকে কেন পাঠিয়েছে।
আকাশ চাইছে এখন ও একা কিছুটা সময় শুধু আমার কাছে থাকতে।
আকাশ আমার হাতে ওর মুখ চেপে ধরে আছে।
- কাজল।
- হুম ?
- ' তোমার চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর। '
এই প্রথম আকাশের মুখ থেকে এই কথাটা শুনলাম।
- যেদিন অফিসে জয়েন করেছিলে, সেদিন তোমার চোখের মায়ায় পড়ে যাই। আমার আশেপাশে এতো মেয়ে ছিলো, কিন্তু কেন জানি তোমার চোখ দুটো আমার মনে দাগ কেটে গেছে। আমি তখন বড্ড বেপরোয়া ছিলাম। দাদুর অনুপস্থিতিতে আমি ভীষণ একা হয়ে যাই।তাই এসবে দিন রাত ডুবে থেকেছি।কিন্তু তারপরও আমি সবার চোখে একটা আশ্রয় খুঁজতাম। কিন্তু সবার চোখ জ্বলজ্বল করতো আমার যশ,নাম আর টাকার জন্য।
সেদিন যখন ডেইজির সাথে এমন করলে, তখন আমার ভেতরে আরও নাড়া দিয়ে গেছো।তোমার মুখ সেই প্রথম দিন থেকে ভুলতে পারিনি। আর অইদিন আরো আন্দোলিত করে দিয়েছিলে।
তোমাকে আমার পি.এ. করেছিলাম কেন জানো?
তোমার বিষয়ে সব খোঁজ নিয়েছিলাম। তোমাকে আরও কাছ থেকে জানার জন্য পি.এ. করেছিলাম।
আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে - সেই দিন পার্টিতে...
- থাক না আকাশ। কেন পুরনো কথা তুলছেন? বাদ দিন এসব কথা।
- না কাজল, তোমাকে শুনতে হবে।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ১১
না কাজল, তোমাকে সব শুনতে হবে।
সেদিন আমি ইচ্ছে করেই তোমার সাথে এমন করেছিলাম। মিথ্যা বলবো না, তোমার জন্য আমার সব ধরনের পেশন ছিলো। তাই তুমি যখন চড় মারলে আমার ভেতরে জেদ চেপে যায়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছি।
কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম তুমি কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবে না। তাই অনেক টা ব্ল্যাকমেইল করেই বিয়ে টা করি।কারণ তোমাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে চাইনি।।
আমার জেদ ছিল ঠিকই, তারচেয়ে বেশী মনের মধ্যে একটা বাসনা ছিলো, কোথাও একটা আশা ছিল যে তোমার মাঝে সবটাই পাবো যা আমি এতো দিন খুঁজেছি।
আমি বোকার মতো হা করে আকাশের কথা শুনছি। তারপর বললাম
- এই জন্যই বুঝি দুই বছরের জন্য বিয়ে করেছিলেন?
আকাশ মৃদুহেসে বলে - তোমার কি মনে হয়, এতো কাঠখড় পুড়িয়েছি দুই বছরের জন্য?
আমি বলেছি আর তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে বিশ্বাস করেছো। এটা দেখে আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। আর সত্যিটা জানাইনি আরও একটা কারণ আছে। আমি চেয়েছিলাম তোমার মনের কাছাকাছি যেতে। তুমি আমাকে অনেক খারাপ ভাবতে আর ভাববেই না বা কেন? আমি এমনই ছিলাম।কিন্ত বিশ্বাস করো আমি আমার জন্য একটা আশ্রয় চেয়েছি তোমার মধ্যে। আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। নারী - বাড়ি -গাড়ি! কিন্তু আমার নিজের একটা মানুষ ছিলো না, যাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচবো।
আকাশের কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিনা।
- এতো দিন তো বলেননি।।
- বলার সু্যোগ হয়ে ওঠেনি।আর বলতে ইচ্ছেও করেনি। চেয়েছিলাম দুই বছর পরে যখন তুমি এই কথা তুলবে তখন বলবো।।
- তবে আজ কেন বললেন?
- আজ বলতে ইচ্ছে করছে তাই।
- ভয় পাচ্ছেন যদি কখনো আর বলতে না পারেন?
- 'না কাজল, ভয় পাচ্ছি না। শুধু তোমার মনের জোর হতে চাইছি,তাই বললাম।
আমি ভীষণ একা। ভীষণ। তোমার বাবা-মা ছিলো, সুন্দর একটা শৈশব ছিল, কিন্তু আমার? সবাই থেকেও আমি একা। আমার শৈশব চিড়িয়াখানার বন্দী জন্তুর মতো ছিলো। বাবা-মা যখন ঝগড়া করতো আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতাম। আমাকে কেউ বুঝতে চায়নি।দেখো না আমার নিজের বাবা-মা ই ফেলে....
তোমার জন্য আমার সব বদলে গেছে। প্রথম দিকে জেদের বশে অনেক রাফ ব্যবহার করেছি।কিন্তু পরে নিজেই গিলটি ফিল করতাম। তোমার কাছে যাবার হাজার টা বাহানা খুঁজতাম। '
সাত সাগরের পানি বুঝি আজ দুজনের চোখ দিয়ে ঝরে পড়বে। কতটা সময় পাবো জানি না। হয়তো এটাই শেষ কথা আকাশের সাথে শেষ কথা। চোখ মুছে আকাশ বললো- মাঝরাতে ঘুমের ভান করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম যাতে তুমি বুঝতে না পারো,আসলে আমি তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিতে চাইতাম। জড়িয়ে ধরলে মনে হয় ফাঁকা যায়গাটা পূর্ণ হয়েছে।
আকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আমি কি বলে সান্ত্বনা দিবো আকাশ কে?
এ কেমন নিয়তি?
- আকাশ?
চোখ মুছতে মুছতে বললো - বলো।
- একটা বার আমাকে জড়িয়ে ধরবেন?
আমাকে ওর বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যদি পারতো হয়তো বুক চিড়ে ভেতরে রেখে দিতো। আকাশের কান্না বোধহয় বাঁধ ভেঙে গেছে। আমিও আকাশকে জড়িয়ে ধরেছি যেন কোনো কিছুই আমাদের আলাদা করতে না পারে।
হয়তো আর কখনো এভাবে ধরতে পারবো না। আকাশের বুকে জড়িয়ে আমার পৃথিবী ভেঙে কান্না আসছে।।
- আকাশ, আমি বাঁচতে চাই। আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই।
আমি পাগলের মতো আকাশের সারা মুখে চুমু খেয়ে যাচ্ছি। এই পাগলটাকে আর কখনো দেখতে পাবো না এটা মনে হতেই ওকে আবারও ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।।
আমি বাঁচতে চাইছি।আমি আকাশের জন্য বাঁচতে চাইছি।
- তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
- আকাশ, প্লিজ তুমি অপারেশন বন্ধ করো।আমি অপারেশন করাবো না।।
- কেন? করাবে না কেন?
- অপারেশন না করলে আমি কয়েকটা দিন থাকতে পারবো তোমার কাছে। অপারেশনে যদি মরে যাই?তবে আর একটা দিনও পাবো না...
- এই মেয়ে! একদম চুপ। আবার যদি এসব কথা বলেছো তো আমিই তোমাকে মেয়ে ফেলবো!
আকাশ কান্না কিছুতেই থামাতে পারছেনা।
এদিকে আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
- আকাশ, ভীষণ ভালবাসি তোমায়। অনেক বেশি...
- আর কোনো কথা নয়।আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাসো। আমিও অনেক বেশি ভালবাসি তোমাকে। তাই আমার কথা শুনতে হবে। চুপ করে শুয়ে থাকো।এতো ট্রেস নেয়া ঠিক হচ্ছে না।
- তুমি আমার হাত ধরে বসে থাকো।
- এইতো আমি হাত ধরে আছি।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমাতে চেষ্টা করো।
দুপুর থেকে আমার খাবার বন্ধ করে দিয়ে স্যালাইন দিচ্ছে। ঘুমের পরিমাণ বেড়ে গেছে আমার। যতক্ষন জেগে থাকি তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করি।
সারারাত কেটে গেছে। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখি আকাশ আমার হাতেই মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে। আমি আকাশকে দেখছি।আমার দৃষ্টি স্পষ্ট নয়,ঝাপসা। ঝাপসা চোখেও আমি দেখছি আকাশকে। একটা হাত আস্তে আস্তে ওর মাথায় রাখলাম। ঘন্টা তিনেক পরে অপারেশন। আমি জানি না আর কখনো ওকে স্পর্শ করতে পারবো কিনা।ভীষণ ভয় হচ্ছে আমার।
আমার হাতের স্পর্শে আকাশ জেগে ওঠে।
- ঘুম ভাঙলো কখন?ডাকলে না আমায়?
ক্ষীন স্বরে বললাম - এখন।
আর কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে।
আমার ভেতরে কেমন একটা করছে। মনে হচ্ছে দম আটকে আসবে। ভয় করছে,ভীষণ ভয় করছে।
সময় হয়ে গেছে। আমাকে ও.টি. তে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশও আমার সাথে যাচ্ছে, আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আছি।শেষ বারের মতো সবাইকে এক নজর দেখে নিলাম। অপারেশন টেবিলে নেবার আগে আমাকে স্যালাইন পাল্টে দিলো।আরও কয়েকটা ইনজেকশন দিলো।
আমার মনে হচ্ছে সারা দুনিয়া ঘুরাচ্ছে।মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। টেনে খুলে রাখার চেষ্টা করছি। আমি চোখ খোলা রাখতে চেষ্টা করছি....
এদিকে আকাশসহ সবাই উদ্ধিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে ও.টি. এর বাইরে। সাড়ে তিন ঘন্টা পরে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। আকাশ ছুটে যায়
ডাক্তারের কাছে।
- ডক্টর??
- অপারেশন শেষ হয়েছে। ৮ ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরবে। তবে রোগীকে এখন ৪৮ ঘন্টা I.C.U. তে রাখা হবে অবজারভেশনে।
- আই.সি.ইউ তে কখন দিবেন, ডক্টর?
- এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
- আমি কি একবার দেখতে পারি?
- সরি মি. আকাশ। এটা এলাউ করা হয় না।
- প্লিজ, ডক্টর একবার জাস্ট দেখেই চলে আসবো।
ডাক্তার একটু ভেবে বললেন - ওকে। শুধু দেখেই চলে আসবেন, তবে আপনাকে অন্য ড্রেস পড়ে যেতে হবে। ইনফেকশনের রিস্ক আছে রোগীর।
- ওকে ডক্টর, থেংকুউ।
- আসুন আমার সাথে।
আকাশ ডাক্তারের সাথে চলে যায়।
কত মিনিট, কত ঘন্টা,কত দিন পরে চোখ খুলেছি আমি জানি না। অক্সিজেন লাগানো।চোখও পুরোপুরি খুলতে পারছিনা। মাথা নাড়ানো যাচ্ছে না। যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীর কেমন ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে।আমি কাউকে ডাকবো এমন শক্তি পাচ্ছি না। তারপর ও সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু গলার স্বর যেন বসে গেছে। বেশ কিছু সময় পরে একজন নার্স কাছে এলো।তাকে বলতে চাইলাম,কিছু বলতেও পারছিনা।হাত দিয়ে যে ইশারা করবো সে উপায় নেই,হাত উপরে তুলতে পারছিনা।কোনোরকম হাতের দুইটা আঙুল নাড়ালাম। নার্স বললো - কিছু বলবেন?
আমি ঠোঁট নেড়ে বললাম - আকাশ।কিন্তু নার্স বুঝতেই পারলো না।।
যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।যদিও অক্সিজেন লাগানো আছে, তবুও নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই চরম পর্যায়ের ব্যথা অনুভব করছি। চোখ যেন বেরিয়ে যাবে ব্যথার তোড়ে।খিচুনির মতো হচ্ছে।
রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে নার্স ভয় পেয়ে যায়।ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে।
আমি অনুভব করতে পারছি যে আমি মারা যাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে মানুষ মারা যাবার সময় এমন অনুভূতি হয়? আমি মরতে চাই না। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। একবার শ্বাস নিলে মনে হচ্ছে এটাই শেষ, পরের নিঃশ্বাস টা আর ফেলতে পারবো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি- হে আল্লাহ, আমাকে বাঁচতে দাও,আকাশের জন্য বাঁচতে দাও।আমি ছাড়া ওর কেউ নেই।
এমন করুণ একটা সময়, আমি আকাশকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি। যাচ্ছি না ; যেতে হচ্ছে। আমি লড়াই করছি বাঁচার জন্য।এমন একটা অদ্ভুত সময় আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই সে নদী, নৌকার বয়ে চলা।একটার পর একটা ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ আমার কানে আসছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার মা রান্নাঘরে রান্না করছে, বারান্দায় বাবার সাথে ছোট্ট একটা মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি।এই মেয়েটা আমি?
নদী দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
বাংলা প্রেমের গল্প 💙 রক্ষিতা 💙 পর্বঃ ১২ শেষ পর্ব
নদী দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মা-বাবা,বাবার সাথে খিলখিল করে হাসা মেয়েটা, আমার চিরচেনা আঙিনা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে.... নাকি আমি সরে যাচ্ছি??
এবার আমি বুঝতে পারছি বাঁচার সব চেষ্টা বৃথা। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও এমন ভিশন হয়!
হঠাৎ আমি নিজেকে দেখতে পাই শুনশান নীরব এক অন্ধকার প্রান্তরে। খোলা প্রান্তরে শুধু অন্ধকার! এই অন্ধকারেও হালকা হালকা দেখা যাচ্ছে চারিদিক। কোথাও কেউ নেই। ভয় পাচ্ছি আমি। ভীষণ ভয়।
আমি কি মারা গেছি? মৃত্যুর পরে এখানে আনা হয়েছে?
কে কথা বলছে? হঠাৎ করে এতো মানুষের আওয়াজ! কোলাহল! কে আমার নাম ধরে ডাকলো? - মামা?
না, অইতো সুমনা ডাকছে। কিন্তু কোথায়? আকাশ ডাকছে, বাবা- মা কথা বলছে! সবাই কথা বলছে! এতো মানুষের কোলাহল! কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন??
- তোমরা কোথায়? আমাকে নিয়ে যাও।
আমি গলা ফাটিয়ে ডাকছি.... কিন্তু....
ঐ তো এইখানে দেখা যাচ্ছে... আমি ছুটে যাই।
মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি। না এখানে কেউ নেই,কেউ ছিলো না ।
কিন্তু সবার কথা শুনতে পাচ্ছি... এই অন্ধকার খোলা ময়দানে.... একি! শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে! আর কোনো শব্দ, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না... সব ক্ষীণ হয়ে গেছে...
আবার সেই নীরবতা।
মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ঘন জঙ্গলের মতো দেখতে পাচ্ছি। এটা কি?
জঙ্গল নয়,এটা কোনো প্রাচীর মনে হচ্ছে। কিসের প্রাচীর? কি আছে প্রাচীরের ঐ পাশে?
হঠাৎ অদৃশ্য একটা শক্তি আমাকে ঘিরে ফেলে। আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যেতে চাইছি না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা ঝলমলে আলো সেই প্রাচীরের গায়ে! যেন একটা ফটক!
আমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে।
হে আল্লাহ, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, একটা বার বাঁচার সুযোগ দাও,এই প্রাচীর পেরিয়ে গেলে আর কোনো দিন ফিরতে পারবো না এপাশে।
আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলাম, সব ব্যর্থ হয়ে গেল।আমি ফটকের ঠিক সামনে। ভীষণ অভিমান হলো।
কার উপর জানি না।
নিতে চাও আমায়? বেশ নিয়ে যাও..
ঠিক এই মুহূর্তে আমার না কোনো ব্যথা করছে, না কোনো যন্ত্রণা, না কোনো অনুভূতি। এক সেকেন্ডের জন্য সব থমকে গেছে, সাথে আমিও।
আমার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল।
রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে দেখে নার্স ভয় পেয়ে ডাক্তার ডেকে আনে।ডাক্তার ছুটে আসে। অপারেশন পরবর্তী সংকট! রোগী জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে অপারেশনের ঝক্কি সামলাতে পারছে না। শারীরিক অবস্থা কিছুতেই পেরে উঠছে না।রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ডাক্তাররা ছোটাছুটি শুরু করলো।
আকাশ আই,সি,ইউ এর বাহিরে বসে আছে। ডাক্তার যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে ডাক্তার কিছু বলেনি।তাড়াতাড়ি রোগীর কাছে গেলেন।
পরে ডাক্তারের ছোটাছুটি দেখে আকাশ বুঝতে বাকি রইলো না যে কাজলের অবস্থা ভালো নয়।
- ডক্টর, কি হয়েছে আমাকে বলুন।কাজল কেমন আছে?
- দেখুন একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে।
আকাশ খুশি হয়ে বললো - আমি দেখা করতে পারি?
- সরি,জ্ঞান ফিরেছে ঠিক, কিন্তু..
- কিন্তু কি ডক্টর?
- অপারেশন পরবর্তী কিছু ঝুঁকি থেকে যায়।এই ধাক্কা সামলানো রোগীর পক্ষে কঠিন।
অপারেশন এর পর একটা অস্বস্তি আর অপারেশনের জায়গায় ব্যথা এটা জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে তীব্র হয়ে যায়। রোগীকে এটা সামলে নিতে হয়।এখন যদি এই অবস্থায় রক্তক্ষরণ হয় তবে রোগী মারাও....
আমরা আবারও ঘুমের ইনজেকশন আরও কিছু মেডিসিন দিয়েছি। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে কখন জ্ঞান ফিরে, কারণ উনার খুব ধকল গেছে যে.... এটা খুবই আশঙ্কাজনক!
আকাশ ধপ করে এখানেই বসে পড়ে। ডাক্তার বললো - 'আপনি চাইলে রোগীর পাশে অপেক্ষা করতে পারেন।তবে কান্নাকাটি বা শব্দ করলে সেটা সম্ভব হবে না।। আসুন আমার সাথে।'
আকাশ এখন আর কাঁদছে না।একদম চুপ হয়ে গেছে। আকাশ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চুপচাপ ডাক্তারের পিছনে গেল।।
৮ বছর পর।
এক পড়ন্ত বিকালে আকাশকে দেখা যায় দুটো ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ের সাথে বাগানে ভলিবল নিয়ে খেলছে। আকাশের পাঁচ বছরের জমজ দুই মেয়ে আরশি আর আভা।আকাশের স্ত্রী বাগানের চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে, সম্ভবত কিছু লিখছে।
জীবন থেমে থাকে না। নানা উত্থান-পতনের আবর্তে জীবন চলে জীবনে নিয়মে। তেমনি সুখ-দুঃখের পালা চলতেই থাকে।
সময়ে কিংবা অসময়ে; প্রিয়জনকে হারানো আশঙ্কা বা হারানো কষ্ট কোনো কিছুর বিনিময়ে ভুলানো যায় না। এই ক্ষত সহ্য করা সত্যিই ভীষণ কঠিন।
কিন্তু সময়, সময় আমাদের অনেক কিছু সহ্য করার অভ্যাস হয়ে যায়। তবুও আমরা চাইনা কেউ হারিয়ে যাক। জীবন চক্রে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। নিয়তির বিধান মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। প্রিয়জনকে হারানোর ভয় বড্ড বেশিই হয়।
তবে, উপরওয়ালা যা লিখে রাখবেন তা-ই হবে,তার ব্যতিক্রম নয়।।
আকাশ নতুন করে জীবন শুরু করেছে। স্ত্রী আর পরীর মতো দুই মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখে দিন যাচ্ছে আকাশের।
দুই মেয়ে বায়না ধরলো আইসক্রিম খাবে।
তাদের বাবাকে রাজি করানো জন্য দুইজন দুইপাশ থেকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলছে- সোনা বাবা না তুমি, তুমি তো আমাদের বেস্ট পাপা, শুধু আজকেই আইসক্রিম খাবো।প্লিজ পাপা,চলনা! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
মেয়েরা যখন কিছু বায়না করে, তখন আকাশকে ' সোনা বাবা ' ডাকে।
আকাশ বেশ উপভোগ করে, তাই আরও কিছু সময় রাজি না হবার অভিনয় করে। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
- কিন্তু তোদের আম্মু কি রাজি হবে?
- তুমি রাজি করাবে।
- ওরে বাবা! আমি নেই।
- পাপা,তুমিও কি আম্মুকে ভয় পাও??
বেচারা আকাশ!পাঁচ বছরের মেয়ে দুটোও জেনে গেছে আকাশ চৌধুরী বউকে ভয় পায়।
মুচকি হেসে বলে - ভয় পাবো না! দেখিস না আমরা খেললেই চেচামেচি করে, গুছানো সবকিছু নাকি নষ্ট করে ফেলি! আমার কানের পোকা মরে যায়!
বাবা - মেয়েদের কথার ভঙ্গি সুবিধার মনে হচ্ছে না। মেয়ে দুটো মুখচেপে হাসছে। আকাশের স্ত্রী সেটা আঁড়চোখে খেয়াল করছে।
লাইন ধরে তিনজন এসে হাজির আকাশের স্ত্রীর কাছে।
- কি চাই?
- আইসক্রিম।
- হবে না।
- প্লিজ একবার।
- নো।
- প্লিজ আম্মু,
আম্মু চলনা অনেক দিন বাহিরে যাইনা একসাথে। সামার ভেকেশন চলে যাচ্ছে।
- পরশুও বের হয়েছিলাম। মাঝখানে একটা দিন গেছে মাত্র!
- বাচ্চারা এতো করে বলছে, প্লিজ চলনা আমারও খুব ইচ্ছে করছে আজ এক যায়গায় যেতে।
- কোথায়?
- আগে চলই না।পরে দেখবে,আইসক্রিম খেতে খেতে যাবো সবাই।
- হুম!! যাও রেডি হয়ে নাও।
আরশি আর আভা খুশিতে লাফাচ্ছে।
আকাশ ওদের নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। আকাশের স্ত্রী তখনও লিখছে।।
আকাশ ফিরে দেখে ওর স্ত্রী উঠার নাম নেই!!
- এই কাজল! তাড়াতাড়ি আসো না! বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে।
- হুম,এইতো আসছি।লেখাটা শেষ করেই... প্রায় শেষ, পাঁচ মিনিট প্লিজ।।
- ওকে, তাড়াতাড়ি কিন্তু
আকাশ মেয়েদের নিয়ে ভেতরে যায়।কিন্তু কাজল কি লিখছে? চলুন দেখে আসি.....
" আমি বুঝতে পারছিলাম মারা যাচ্ছি, আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কোনো অনুভূতি নেই।তারপর মনে হয় কত যুগ কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে গেছে। আমি চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করছি কোথায় আমি। আমি কি মারা গেছি? মৃত্যুর পরে এখানে এসেছি?
ভালো করে চোখ খুলে দেখি আমার চিরচেনা একটা মুখ- আকাশ ; আমার হাত ধরে বসে আছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি মারা যাইনি।
এই প্রথম অনুভব করলাম বেঁচে থাকার স্বাদ।। মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছি,শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ি ইনজেকশন দেয়ার পর।
তারপর কয়েকমাস কেমোথেরাপি নিয়ে বছর দেড়েক পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠি।
আমি আমার আকাশ, আরশি- আভা,এই বাড়ি, সংসার দু'হাতে আগলে রেখেছি আমার বুকে।আকাশ আর আমি দুজন দুজনের রক্ষাকবচ।একটা মুহূর্ত তাকে ছাড়া অন্যকিছু আমার ভাবনায় নেই। মেয়ে দুটো আমাদের চোখের মণি। একদিন আমাদের মেয়েরা বড় হবে, ওদের বিয়ে দিবো।
আমি আর আকাশ বুড়ো হবো! আকাশের চুলে পাক ধরবে! হয়তো মুখভর্তি দাড়ি থাকবে? কেমন দেখাবে আকাশকে?🤔🤔
আমরা দুজন বুড়ো-বুড়ি মিলে বসে বসে পুরনো স্মৃতি আওড়াবো।বুড়ো আকাশ তার বুড়ো বউকে নিয়ে রোজকার মতো সকালে হাঁটতে হাঁটতে সেই শিউলি তলায় এসে দাঁড়াবে। যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকবে আকাশ কিছু ফুল কুড়িয়ে আমার আচঁলে দিবে।🙂☺
# সমাপ্ত #
ছোট্ট একটা বাস্তব ঘটনাঃ-
২০১৭ সাল,একটা মেয়ে হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে,তীব্র মাথাব্যথা। এক সপ্তাহের মধ্যে চোখ ঝাপসা থেকে ঝাপসা হয়ে যায়। অনেক ডাক্তার কারণ খুঁজে পায় না।শেষ পর্যন্ত এক ডাক্তার জানায় মেয়েটার ব্রেইন টিউমার! পরিবারের কেউ মেয়েটাকে জানায় না, কিন্তু মেয়েটা জেনে যায়। তখন মেয়েটার মনের অবস্থা কি কেউ অনুমান করতে পারেন? যে মেয়েটা জানতে পেরেছে তার সময় সীমিত!
৪ দিন এই অবস্থায় যাবার পর নিউরোলজিস্ট চূড়ান্ত রিপোর্টে জানায় - ব্রেইন টিউমার নয়,মেয়েটার হাউড্রোক্যাফালাস হয়েছে ( মস্তিষ্কে পানি জমা), যাতে মেয়েটা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমনকি শেষ পর্যন্ত মারা যাবে যদি এই পানি ব্রেইন থেকে বের করা না হয়। একদিন পরেই থেকে একটা সার্জারীর মাধ্যমে এক সপ্তাহ ব্রেইন থেকে পানি বের করা হয়। প্রথম যখন চোখ মেলে তখন টানা ২ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত বেঁচেযায়। তবুও নতুন করে শঙ্কা দেখা দেয় ব্রেইন টিউমারের!পুনরায় পরীক্ষার মাধ্যম নিশ্চিত হয়, টিউমার নেই।
১৫ দিন হাসপাতালের তিক্ত অভিজ্ঞতা আরও মাস খানেক নিজের ভারসাম্য রেখে একা হাঁটতে পারতো না। মেয়েটার চোখ ৮০% নষ্ট হবার কথা ছিলো ( অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছে)কিন্তু আল্লাহর রহমতে ৮০% ভালো, আর ২০% ড্যামেজ হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বছর দেড়েক সময় গেছে। কাজলের অসুস্থ কালীন অনুভূতি , মৃত্যুর সাথে লড়াই ; সব মেয়েটার বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিচ্ছবি। একটা প্রেমের গল্পে জীবনের এসব ঘাত-প্রতিঘাত তুলে ধরতে চেয়েছি।
গল্প জীবনের বাইরে নয়। আংশিক সত্যকে কেন্দ্র করে কল্পনার জাল বুনে অলঙ্করণ করা হয় একটা গল্প। এটা ইরাবতী সিরিয়াল ( আমি সিরিয়াল দেখিনা,কমেন্ট পড়ে নাটকের খোঁজ নিয়েছিলাম 😌! )বা শাবনূরের ছবি দেখে বা ভেবে লিখিনি। মূলত মেয়েটা যে মানসিক অবস্থায় ছিলো সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছি।
আপনাদের ভালো লাগলে লেখার স্বার্থকতা। 🙂
আল্লাহর রহমতে আর সকলের দোয়া ও ভালবাসায় বেঁচে যাওয়া সেই মেয়েটি ; আমি। 🙂
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি।☺☺
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url